Thursday, December 31, 2020

ঘুম

সদ্য ঘুম ভেঙে চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা থেকে মাটিতে পা ফেলতেই টের পেলাম পা দুটো অসাড়। মাটিতে পা ফেলে হেঁটে ওয়াশবেসিনের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে টুথব্রাশটা হাতে তুলে নিতে নিতে বুঝলাম, হাতটাও। কিন্তু এইমাত্র যে চোখ কচলালাম, দিব্যি হাতটা ফিল করলাম মুখের ওপর! ঘুমের ঘোরে ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে, মুখে একঝাপটা জল মারতেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত খেলে গেলো। একফোঁটা জলও অনুভব করলাম না আমার চোখ, গাল, থুতনি কোত্থাও। পাগলের মত জলের ঝাপটার পর ঝাপটা মারতে লাগলাম মুখে, নাহ কিচ্ছু টের পাচ্ছি না। হুড়মুড়িয়ে আবার চোখ কচলানোর ভঙ্গিতে চোখে মুখে হাত বোলাতে যাবো, হঠাৎ চোখ পড়লো সামনের আয়নায়। আয়নায় আমার প্রতিফলন কই!
 
দুই হাত কখন যে চোখ, মুখ, নাক ঘুরে মাথায় উঠে গেছে টেরই পাইনি। ভয়ে বুকটা ধড়ফড় করছে, নাভিশ্বাস উঠছে টের পাচ্ছি। একটা ফোন করতে হবে। ছুট্টে বেডের ওপর রাখা আমার মোবাইলটা নেওয়ার জন্য বিছানার দিকে মুখ ফেরাতেই চোখে পড়লো, আমার বিছানায় ঠিক আমার মত একজন শুয়ে, হাত দুটো চোখ কচলানোর ভঙ্গিতে, ঠিক যেন ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে আবার শুয়ে পড়েছে।

Saturday, December 26, 2020

এবং

আমি এবং,
মেঘের বুকে গল্প গড়া, বর্ষা না-নামা চিঠি,
শীতের সকালে ঝরে পড়া, কুয়াশার নাম না লেখা অবয়বে,
জানলার ওপর ঝাপসা হতে থাকে দিন দিন তার পুঙ্খানুপুঙ্খতা।
 
আমি এবং,
আমার সবুজ ঘাসে ভেজা মাঠ,
লুটোপুটি খাওয়া, বাধ না মানা,
আবেগঘন সন্ধ্যার বুকে তোমার চোখটিপে হাসা,
সূর্যাস্তের নীলিমা মাখা অন্ধকারে আজও ভাস্বর।
 
আমি এবং,
আমার পাখিডাকা, গাছের নীচের ছায়া,
দিগন্তব্যাপি চরাচর বেয়ে হাত বোলানো রোদ জল কাদা মাখা আমাদের সকাল দুপুর সন্ধ্যের কলকাকলি,
ভীড় রাস্তা, বাস ট্রাম, জনজোয়ারের ভীড় ঠেলে আজও ভাটিয়ালি গায়।
 
আমি এবং,
আমার লেপমুড়ি দেওয়া ভোর,
রোজ সকালে কুয়াশা মাখি, রৌদ্রস্নান করি,
কুয়াশা ভেজা মেঘের পাল্লার বুকে আঁচড় কাটি,
লেপমুড়ি ভাঙা রৌদ্রস্নানে আজও তার ছোঁয়া,
অভিমানি জ্যোৎস্না মাখা নিশুতি রাতে আজও ঠাঁই, পাহারাদার। 
 
শেষ সম্বল টুকু দিয়ে আঁকড়ে ধরা জানালার পাল্লা, ঘাসের ডগা, মোলায়েম পাতার বুক বেয়ে ঝরে পড়ার আগেও বলে যাওয়া,
যে কাল গেছে তা গেছে,
সামনের আঁকাবাঁকা গলিপথ বেয়ে যে অদূর ভবিষ্যৎ,
তা তোমার, তা আমার, এবং....।

Monday, November 23, 2020

জমিদারি নয়

মন্দবাসা গুলো ভীড় করে আসে আসুক না, 

রোজ সকালে, চোখের জলে দিনটা ভাসে, ভাসুক না।

দিনের শেষে, রুক্ষ বেসে, কষ্ট গুলো দেয় নাড়া, 

মনের ঘরে একলা, ডরে, ইচ্ছেগুলোও ঘরছাড়া!

সময়ে অসময়ে অদৃষ্টও তোমায় দেখে হাসুক না, 

তোমার হৃদয়, কারো জমিদারি নয়, নিজের মত বাঁচুক না। 


সন্ধ্যে হলে, আঁধার নামে, মনের গহনে মৃত্যু চাও,

মনে হয় কেউ তোমার নয়, মৃত্যু হলে মুক্তি পাও! 

গলা ফুঁড়ে আসে কষ্টগুলো, গিঁট মেরে যায় আলজিভে!

তবুও কি আজও স্বপ্ন দেখো, সময় কাটাতে মালদ্বীপে!

তোমার জীবনে, তোমার মনে স্বাবলম্বন জাগুক না, 

তোমার জীবন কারো জমিদারি নয়, নিজের মত বাঁচুক না। 

Saturday, November 21, 2020

হাল ছেড়ো না বন্ধু

আজকে সে নাহয় জিতেই গেছে, কাল অবধিও হারতো,
কালকে রাতেও এগিয়ে যাওয়ার হাল ছেড়ে দিতে পারতো। 
 
আজকে নাহয় সুর সেধেছে, কাল অবধিও ছড়িয়েছে,
কালকে রাতেও হারমনিয়াম টা এপাশ ওপাশ গড়িয়েছে।
 
আজকে নাহয় পান চিবিয়েছে, কাল অবধিও খসেছে চুন,
কালকে রাতেও পাড়ার রকে ডান্স করেছে সেজে মিঠুন।
 
আজকে নাহয় ধ্রুবতারা চিনে খুঁজে নিয়েছে হাঁটার পথ,
কালকে রাতেও কালপুরুষকে দেখে বলেছিল ঐরাবৎ।

Friday, November 13, 2020

চশমা

ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। ঝাপসা চশমার কাঁচে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এরকম অবস্থায় ছাতা হাতে আর এগিয়ে যেতে না পেরে, একটা বন্ধ চায়ের দোকানের ছাউনি এর নীচে গিয়ে দাঁড়ালো আবির। ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমালটা বের করে চশমার কাঁচটা মুছতে মুছতে হঠাৎ রাস্তাটা যেন পরিস্কার হয়ে গেল চোখের সামনে। আর চোখে পড়লো রাস্তার ওপারে একটা মেয়ে। বয়স খুব বেশী হলে আঠারো থেকে কুড়ি, রাস্তা পেরোনোর চেষ্টায় দোনামনা করছে। খুব চেনা চেনা ঠেকছে মুখটা, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না আবির।
 
কে, কোথায় দেখেছে ভাবতে ভাবতেই, হঠাৎ একটা দৌড়ে রাস্তা পেরনোর জন্য পা বাড়ালো মেয়েটি। ঠিক মূহুর্তের মধ্যেই ডান দিকের একটা বাঁক থেকে একটা গাড়ি তীব্র গতিতে এগিয়ে আসতে দেখে আবিরের হাত পা কেঁপে উঠলো। হাতের চশমাটা হাত থেকে পড়ে গেল। তার পা দুটো অস্থিরতার মধ্যে মূহুর্তে দৌড় লাগালো মেয়েটির দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবির ঠিক গাড়ির সামনে। ইতিমধ্যে মেয়েটা আবিরের একদম সামনে, যেন খিলখিলিয়ে হাসছে আবিরের দিকে চেয়ে। সেই হাসি মাখা চেহারাটা দেখে সারা শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল আবিরের। মূহুর্তে গাড়িটা তার শরীরের হাড় গোড় ভেঙে ফেলার আগে আবিরের মনে পড়ে গেল, ঠিক এই রাস্তার ওপরেই, এরকম একটা বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যেতে আবিরের চলন্ত গাড়ির কাঁচে এসে ধাক্কা খেয়েছিল এই চেহারাটাই।

Tuesday, November 3, 2020

আঙুল

ঝোপ জঙ্গলের ডালপালা ঠেলে, কাঁটা-পাথর উপেক্ষা করে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে চলেছে মায়া। ভয়ে, ক্লান্তিতে চোখ মুখ লাল কালো ছোপে ভরে গেছে। পা দুটো ছড়ে রক্তাক্ত, তবুও হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় হিঁচড়ে নিজেকে টেনে নিয়ে চলেছে। ঘন্টা খানেক আগেই যে পরিস্থিতিটা সে পেরিয়ে এসেছে, ভাবতেই তার জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। মাথার ওপর রোদের ছিঁটেফোঁটা যা ছিলো, কখন যে একরাশ ভয় উদ্বেগ মাখা অন্ধকারে পরিণত হয়েছে খেয়ালও করেনি। হাতের কব্জি ঘিরে লাল গোলাকার দাগ থেকে লাল রক্তের ফোঁটা চুঁইয়ে আঙুল বেয়ে সবুজের বুকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
সামনে এক বিশাল হাড়িকাঠ, একটা আস্ত মানুষ গলে যাওয়ার মত। চারিদিকে সব অদ্ভুত দর্শন, গাছের ডাল পাতা আবৃত, রঙ মাখা একদল জীব দুহাত তুলে লাফাচ্ছে আর কান ঝালাপালা করা শ্রুতিকটু শব্দে ভরিয়ে দিচ্ছে আকাশ, বাতাস, বাতাবরণ। মাথার একপাশের একটা টনটনে ব্যাথা আর হাতে পায়ে তীব্র জ্বালায় খেয়াল হলো, একটা মোটা দড়ি দিয়ে তার হাত পা একটা মোটা লম্বা কাঠের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে, আর তার সাথে আরো জনা তিন চারেক। ঝাপসা চোখে চারিদিকের ভয়াবহ রূপটা দেখে সারা শরীরে, রোমে রোমে আতঙ্কের পুঞ্জীভূত অ্যাড্রানালিন রাসটা গা বমি দিয়ে বেরিয়ে আসছে প্রায়। হঠাৎ তার আবছা দৃষ্টিতে পড়লো, হাড়িকাঠের ঠিক পাশে একটা ধড় থরথরিয়ে কাঁপছে, আর ফিনকি দেওয়া রক্তে ভরে গেছে তার চারপাশ। এরমধ্যে একজন ওই ধড়ের ডানহাতের কড়ে আঙুলটা পাথরের এক ঝটকায় কেটে একটা পাতায় মুড়ে কয়েকপা দূরের এক জ্বলন্ত আগুনের চাঁই এর মধ্যে ফেলে দিয়ে আবার দুহাত তুলে লাফাতে লাগলো। 
 
এরপর আর কিছুই খেয়াল নেই তার। তবে ঝোপ জঙ্গল বেয়ে সে ছুটে চলেছে, জনবসতি অঞ্চলে এসে না পৌঁছানো অবধি তাকে ছুটেই যেতে হবে, এ ব্যাপারে তার মনে একাংশও সন্দেহ নেই। মাঝে মধ্যে দূর থেকে সেই শ্রুতিকটু শব্দের হুল্লোড় কানে এসে পৌঁছাচ্ছে তার। হঠাৎ এক ঝটকায় কে যেন তার হাতটা ধরে টান মারলো। তীব্র জ্বালায় হাতটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। জ্বালা, ব্যাথা, ভয়, উদ্বেগের মধ্যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, টানতে টানতে সোজা এক গুহার মুখে। এখনো চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, তবে যে চেহারাটা চোখে পড়ছে, তা আর ‌যাই হোক ভয়ংকর নয়। একটা অদ্ভুত শান্তি আর শ্রান্তিতে আবার জ্ঞান হারালো মায়া।
 
টিমটিমে একটা আলো এসে পড়ছে চোখে। টনটনে যন্ত্রনায় মাথাটাও ভার। তবে খেয়াল করলো হাত, পায়ের জ্বালা, ব্যাথাটা এখন বেশ কম। চোখ খুলতেই এবার স্পষ্ট দেখতে পেলো সে একটা সুন্দর গোছানো ঘরের মধ্যে একটা নরম বিছানায় শুয়ে, আর তার সামনে, জ্ঞান হারানোর আগের সেই চেহারাটা। মুখে একটা স্মিত হাসি আর ডানহাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। হঠাৎ এরপর যেটা তার চোখ পড়লো, তা দেখে মায়ার সারা শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত খেলে গেলো, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনের ব্যাক্তিটির সিগারেট ধরা ডান হাতের কড়ে আঙুলটা, অর্ধেক, ঠিক মাঝখান থেকে কাটা।

Sunday, November 1, 2020

কাঁধ

হঠাৎ, অনেকদিন পর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার উত্তেজনাটা আনন্দ ও স্মৃতিমেদুরতায় ভরে গেলো যখন তেঁতুলগাছটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে সামনের সবুজ ধানক্ষেতটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এরই মধ্যে আচমকা, তেঁতুল গাছের ফোকর থেকে কাঠবিড়ালিটা আমার গা ঘেঁষে, সামনের মোরামের রাস্তা পেরিয়ে ধানক্ষেতে বিলীন হয়ে গেলো।

 
সাপখোপের উপদ্রব এদিকে খুব বেশী তাই গা ঘেঁষা শিরশিরে হাওয়ায় চমকে উঠেছিলাম। হৃদস্পন্দনটা সামান্য হতেই হঠাৎ ডান কাঁধের ওপর একটা চাপ অনুভব করলাম, যেন কেউ হাত রাখলো আমার কাঁধে। হুড়মুড়িয়ে পেছনে ফিরে দেখি, কেউ কোত্থাও নেই। শুধু কয়েকশো মিটার দূরে ধানক্ষেতের মধ্যে ভাঙা হাঁড়ি আর ছেঁড়া, খুব চেনা চেনা একটা জামায়, কাকতাড়ুয়াটা যেন আমার দিকে এক অদ্ভুত গোলগোল অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। আবার মুখ ফেরাতেই, এবার যেন একটা ধাক্কা পড়লো পিঠে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার ধাক্কা, ধাক্কার পর ধাক্কা। আর সেই ধাক্কার চোটে আমিও যেন হাঁটতে লাগলাম, কোনো এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে।
 
জলের একটা ঝাপটায় আচমকা চোখটা খুলে দেখি, তেঁতুল গাছের নিচে খাটিয়ার ওপর শুয়ে আমি, আর আমাকে ঘিরে চারিদিকে আমাদের গ্রামের লোকজন। তাদের মধ্যেই একজন বলে উঠলো, 'কিরে এতদিন পরে বাড়ি ফিরেই, শ্মশানে কি করতে গিয়েছিলি!' আর এই প্রশ্নতেই স্মৃতি থেকে ভেসে উঠলো, ওই তেঁতুল গাছের নিচে বসে আমার দাদুর বলা কথাটা, 'যেদিন শ্মশানে যাব, আমার দাদুর কাঁধে চড়েই যাব।'
 
বছর তিনেক হয়ে গেলো দাদু মারা গেছেন, তার শেষকৃত্যে আমার আসা হয়ে ওঠেনি। কেউ যেন আবার বলে উঠলো, 'ওই কাকতাড়ুয়াটার জামাটা দেখছিস! ওই জামাটা পরেই তোর দাদু মারা গেলেন। তার শেষ ইচ্ছে ছিল, যে জামা পরে তিনি মারা যাবেন সেটা যেন এই কাকতাড়ুয়াটা কে পরিয়ে দেওয়া হয়'। আবার চোখ ফেরালাম কাকতাড়ুয়াটার দিকে, সেই অপলক দৃষ্টির অদ্ভুত ভাবটা আর নেই। অনুভব করলাম, কাঁধের ওপর চাপটাও আর নেই আর চোখে পড়লো, তেঁতুল গাছের নিচে কাঠবেড়ালির নিথর দেহটা পড়ে রয়েছে।

Friday, October 30, 2020

স্পর্শকাতর

আজকাল দিন বড়ই শক্ত, আবেগ জমে পাথর,
রোদ জল হাওয়া আমিষাশী, শিশির স্পর্শকাতর।
পায়ের নীচে ঘায়ের জমি, গায়ে বালি কিচকিচ,
হাত ছুঁয়ে গেছে আলকাতরা, আঙুল ভরা পিচ।

মাথার উপরে উড়ে যায় পাখি, ভয়-ময় মাথা ঢাকি,
বৃষ্টির ছাঁট, বন্ধ কপাট, আড়ালে আবডালেই থাকি।
শ্বাসবায়ু বিষ, ধারালো ধান-শিষ, পেট কাটে সিঁধ চোর,
সময়ের বুকে, গাড়ি ঘোড়া ঠুকে, যে যার দিচ্ছে দৌড়।

আঙুলে আঙুল ছুঁলে ঘাম জমে হাজা, প্রেম ট্রেম-এ লকডাউন,
চোখে চোখ পড়ে, রাগে গরগরে নেশা বুঁদ বি-টাউন,
হাথরাস, ফ্রান্স ঘুরে শীতঘুম দিয়ে দিব্যি গায়ে আতর,
তুমি আমি আমরা সবাই কোলেস্টেরল, ঘুম যে স্পর্শকাতর।

Saturday, June 6, 2020

গল্পের নায়ক

আমার টেবিলটা বেস ছড়ানো ছেটানো। সামনের অর্ধেক ভর্তি চায়ের কাপের ঠান্ডা চা এর সাথে মিশে থাকা সিগারেটের ছাই তলিয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। ধোঁয়ার গন্ধে ম-ম করতে থাকা আমার ছোট্ট ড্রয়িংরুমের চেয়ারে বসে, ভাবছি বেস খানিকক্ষণ। ল্যামির ফাউন্টেন পেন টা হাতেই নড়ে চলেছে অবিরত। প্রধান চরিত্রটা রচনা করতে বসে, সবে দুটো লাইন লিখেছি। লেখক হিসেবে এই প্রথম কোনো লেখক চরিত্রের পটভূমি লিখতে বেস কাঠ খড় পোড়াতে হচ্ছে বুঝতে পারছি। অ্যাশট্রে-র ওপোর রাখা মার্লবোরো সিগারেটটাও দেহ রেখেছে, সে অনেকক্ষণ হবে, খেয়াল নেই। আলতো হাতে আবার একটা লাইন লিখতে যাবো, হঠাৎ মাথাটায় কেমন একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠে, বন্ধ জানালার পাল্লা গুলো খুলে, আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আবার এসে বসলাম টেবিলের পাশের চেয়ারটায়। মাথায় ঘুরতে থাকা বেস কিছু আইডিয়া এবার সন্তর্পণে লিখে ফেল্লাম খাতার ওপর। প্রধান চরিত্রর পটভূমিটা প্রায় তৈরি।

উত্তর কোলকাতার এক নাম না জানা ছোট্ট গলির মধ্যে প্রায় শয়েক মিটার ভেতরে এক ভাঙাচোরা ঘরের দোতলায় আমার বাস, প্রায় বছর তিনেক। এলাকাটা ঘিঞ্জি হলেও, নিচের তলা তো বাদই দিলাম, এই গলিতে আমি ছাড়া আর কেউ থাকে বলে এই তিনবছরে দেখিনি। প্রত্যন্ত পুরুলিয়ার এক গ্রাম থেকে কোলকাতায় এসে, এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের পড়ে থাকা বাড়িতে এসে মাথা গুঁজি। প্রথম প্রথম দু'একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করেছিলাম। কিন্তু তার সাথে লেখালিখিতে মোটেই সময় দিয়ে উঠতে পারতাম না। অগত্যা বছর খানেক আগে, চাকরি বাকরি ছেড়ে, লেখালিখিতে সম্পুর্ণ মননিবেশ করার কথা ঠিক করি। এই ঝুরঝুরে পোড়খাওয়া বাড়ির জন্য মাসের শেষে টাকা গুনতে হয়না, তাই একা মানুষ, ঠিক মানিয়ে নিচ্ছি।

আমার ড্রয়িংরুমটা আমার টেবিলের মতই ছড়ানো ছেটানো। খোলা জানালার পাশে একটু বাম দিক ঘেষে আমার টেবিল। জানালার ঠিক উল্টো দিকটায় আমার বসার চেয়ারটা রেখেছি। মাঝে মধ্যে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে যেতে বেস ভালো লাগে। এখন জানালার বাইরে দিয়ে যে আকাশটা দেখা যাচ্ছে তা পুঞ্জিভূত রোষ নিয়ে যেন ফুঁসছে, যে কোনো মুহুর্তে ফেটে পড়তে পারে। হোলোও ঠিক তাই। বাইরে থেকে একটা ঝিরঝির শব্দ কানে আসছে, আর সাথে মাঝে মধ্যেই গুড়গুড় শব্দও। বুঝলাম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হালকা বৃষ্টির ছাট এসে গায়েও লাগছে বলে মনে হোলো। আমার চোখ কিন্ত ঠায় আমার খাতায় লেখা লাইনগুলোর ওপর।

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল এর শেষে সন্ধ্যে নামার মুখে। প্রধান চরিত্রটা বেঁধে সবে দ্বিতীয় চরিত্রটায় হাত দিয়েছি, হঠাৎ দরজায় একটা টোকা পড়লো। এই অসময়ে আমার দরজায় টোকা এই তিনবছরে একবার পড়েছিল, সেও প্রায় বছর দুই আগে। আমার ওই দূরসম্পর্কের আত্মীয় জানাতে এসেছিলেন যে তিনি বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এই বাড়ির সম্পুর্ণ দায়িত্ব আমার। তারপর আমার দরজায় টোকা দেওয়ার মত, আমার এই গলিতে থাকা বেড়াল, আর সকালবেলা দুধওয়ালা, লন্ড্রিওয়ালা আর খবরের কাগজওয়ালা ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার একবার টোকা, একই রিথমে। না বেড়াল নয়। লেখা নিয়ে বসেছি, চরিত্রটার বিভিন্ন লেয়ার কিভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে বিভিন্ন আইডিয়া মাথায় ঘুরছে, এর মধ্যে দরজায় টোকাটা বেস বিরক্তিকর ঠেকলো। ইতিমধ্যে আরো একবার, তবে টোকা নয়, প্রায় হাতের তালু দিয়ে ধাক্কা বল্লেই চলে। বেস বিরক্তি ও কিছুটা রাগের মাথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা খুলতে যাব ওমনি আরো একবার ধাক্কা। মাথার রগটা ইতিমধ্যে ফুলে উঠেছে, এক ঝটকায় দরজাটা খুলে রীতিমতো গালিগালাজ করতে যাব, হঠাৎ চোখে পড়লো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, প্রায় কাকস্নান করা এক যুবতি। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই সে বোল্লো, "মাফ করবেন, এই বৃষ্টি বাদলের মধ্যে আটকে পড়ে গলিতে ঢুকে পড়েছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টিটা বেড়ে যাওয়ায় আপনার সিঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে যেভাবে জল গড়াচ্ছে! একমাত্র আপনার জানালাটা খোলা দেখে, কিছুটা বাধ্য হয়েই দরজা ধাক্কালাম। যদি এই বৃষ্টির সময়টা একটু আশ্রয় পাওয়া যায় তো বাধিত হই। বৌদির কোনো শুকনো শাড়ি থাকলে একটু চেঞ্জ করে নিতে পারি, না হলেও চলবে, শুধু এই বৃষ্টির সময়টা যদি..."। আমি এমনিতেই মিতভাষী, মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে আবার একটু আমতা আমতাও করি, তার ওপোর এতগুলো কথা একটানা কতদিন পর শুনলাম, খেয়াল নেই। অগত্যা কিছুটা ইতস্তত হয়েই, মাঝপথে তার কথা থামিয়েই বোল্লাম, "ভেতরে আসুন"।

তারপর বেস খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। সে ঘরের ভেতরে আসতে আমি আমার একটা আলখাল্লা শুকনো জামা আর একটা কাচা ইস্তিরি করা ধবধবে সাদা পাজামা তার দিকে বাড়িয়ে, বিরক্তিকর নিরবতা কাটিয়ে বল্লাম, "মাফ করবেন, এখনও বৌদির জোগাড় করে উঠতে পারিনি, যদি এই জামাটায় কাজ চলে যায়, তাহলে পাশের ঘরটায় গিয়ে চেঞ্জ করে নিতে পারেন।" ভদ্রমহিলার চোখে মুখে ইতস্ততভাবটা স্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ডের ইতস্ততা কাটিয়ে আবার বল্লাম, "দরজার ছিটকিনিটা একটু সমস্যা করে, দরজাটা একটু জোরে টেনে ছিটকিনিটা লাগাবেন, আটকে যাবে"। এতগুলো কথা এক ঝটকায় বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেল্লাম। ইতিমধ্যে ভদ্রমহিলা সটান ভিতরঘরে গিয়ে দরজাটা এক ঝটকায় লাগিয়ে দিয়েছেন। বুঝলাম, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর আলুথালু চুল দেখে বয়সটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে আমার। আমি আবার আমার চেয়ারটা টেনে, হাতে কলম তুলে বসলাম।

কলমটা বেস চলছে হঠাৎ। দ্বিতীয় চরিত্রটা ফেঁদে গল্পের পটভূমি টা লিখতে সবে শুরু করেছি, হঠাৎ একটা শব্দে গল্পের জগৎ থেকে বাস্তবে এসে পড়লাম। আমার ছড়ানো ছেটানো ঘরে হাঁটাচলা করা আমি ব্যাতিত অন্য কারুর পক্ষেই বেস কষ্টকর। পেছন ফিরে দেখি, ভদ্রমহিলা আমার জামা আর পাজামা পরে, দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন। তার পায়ের সামনে গড়াগড়ি খাওয়া আমার একটা ঘটি থেকে জল পড়ে আমার মেঝেটা ভিজিয়ে দিয়েছে। আমি বিস্মিত হব, হাসবো নাকি রাগ দেখাবো বুঝে ওঠার আগেই, ভদ্রমহিলা বল্লেন, "মাফ করবেন, এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিনিসপত্র রাখলে তো এরকম হবেই। আমায় একটা শুকনো ন্যাকড়া দিন, আমি জলটা পরিস্কার করে দিচ্ছি। ও হ্যাঁ আমার নাম চন্দ্রানী।" রান্নাঘর থেকে একটা শুকনো ন্যাকড়া এনে তার হাতে দিতে দিতেই চড়াক করে মাথায় খেলে গেলো একটা ভাবনা, 'কি নাম, চন্দ্রানী!' ছুট্টে আমার টেবিলটায় গিয়ে চোখ বুলিয়ে দ্বিতীয় চরিত্রটার নাম খুঁজে দেখি, চন্দ্রানী। বর্ননাটা কিছুটা এরকম, 'মাঝবয়সি, আলখাল্লা জামা আর পাজামায় অভ্যস্ত বাম চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত এক সুঠাম যুবতি চন্দ্রানী। গ্রামে গঞ্জে গিয়ে দুস্থদের সেবা সুস্রুসায় ব্রতি এক এন.জি.ও -র সাথে বেশ কয়েক বছর যুক্ত।' তড়াক করে জিজ্ঞেস করে বসলাম, 'কি করা হয় আপনার!' মৃদু একটা হাসি ঠোঁটের কোণে টেনে এনে চন্দ্রানী বোল্লো, "তা গুছিয়ে বলতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, চা খাবেন! আপনার টেবিলে চায়ের কাপ দেখে অনুমান করছি, রান্নাঘরে চা এর সরঞ্জাম সবই মজুদ আছে। আমার হাতের চা এর সবাই বেশ প্রশংসা করে, তার সাথেই নাহয় আমার কাজের ব্যপারটা খুলে বলবো। কি রাজি!" আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরলো না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই, চন্দ্রানী রান্নাঘরে চলে গেলো চা বানাতে। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম খাতাটার ওপর, লাইনটা জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে, 'তবে তার কাজের জন্য যতটা সমীহ সে দাবি করে, ঠিক ততটাই প্রসংশনীয় তার হাতের চা।'

তাহলে কি, আমার লেখা চরিত্রটা আমার চোখের সামনে ফুটে উঠছে! এতক্ষণ গল্পের প্রধান চরিত্রটা আমায় ভাবায়নি, কিন্তু এবার ভাবাচ্ছে। ল্যামির পেন, মার্লবোরো সিগারেট সব যেন এক্কেবারে মিলে যাচ্ছে। পেনটা খাতার মধ্যে রেখে, হুড়মুড়িয়ে বন্ধ করে দিলাম খাতাটা। মাথাটায় আবার কিরকম চিনচিনে একটা ব্যাথা। একটা সিগারেট বের করে ধরাতে যাবো ততক্ষণে চন্দ্রানী ট্রেতে করে চায়ের দুটো কাপ সাজিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ট্রে থেকে কাপ দুটো টেবিলে রেখে, আমার চেয়ারটা চন্দ্রানীকে ছেড়ে দিয়ে, আরেকটা চেয়ার টেনে বসলাম তার পাশেই। চায়ে চুমুক দিতে দিতে চন্দ্রানী বলতে শুরু করল, "আমি আসলে একজন নার্স, সামনের দুটো লেন ছেড়ে যে নার্সিংহোমটা আছে ওখানেই আমি কাজ করি।" শুনেই মন থেকে ভারটা যেন নেমে গেলো, যাক তাহলে এতক্ষন যা ভাবছিলাম সবটা নেহাতই কোইনসিডেন্টাল। আর স্বস্তির বিষয় হোলো গল্পের লেখক বিবাহিত, নাম রেখেছি রুদ্র। "ওহো খেয়ালই করিনি, শুধু শুধু চা খাচ্ছেন, দাঁড়ান কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসি", বলে খোস মেজাজে রান্নাঘর থেকে প্লেট সাজিয়ে বিস্কুট এনে রাখলাম টেবিলে। "আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হোলো না" বলে উঠলো চন্দ্রানী। কিছুটা লজ্জান্বিত হয়েই বোল্লাম,
- "ইসসস দেখেছেন তো কি ভুলো মন, আমার নাম নীল।"
-"বাহ বেশ ভালো নাম, নীল, শিবের নাম। আমার ভাইয়ের নামও শিবের নামে রাখা, রুদ্র।"
আবার একটা খটকা, রুদ্র! আমার গল্পের লেখকের নাম! দুম করে আবার একটা প্রশ্ন করে বসলাম,
- "লেখালিখি করে!"
- "ভাই আর লেখালিখি, না না। আন্তপ্রনয়র এর কাজ করে, প্রধানত সফটওয়ার ডেভেলাপমেন্টের কাজ। আর সাথে ওই একটু আধটু ব্লগ লেখা, এই যা। বিয়ে থা করে এখন দিব্যি সংসার করছে। বৌ এর নাম কৃত্তিকা।"
- "আর আপনি, বিয়ে থা করেননি!"
-"না আসলে, আমি একটা এন.জি.ও. এর সাথেও যুক্ত। গ্রামে গঞ্জে গিয়ে দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে বেস খানিকটা সময় বাইরে বাইরেই কাটাতে হয়। বিয়ে থা এর ব্যাপারে ভেবে ওঠারই অবকাশ পাইনি।"

সব যেন কিরকম গুলিয়ে যাচ্ছে। যেন এক শব্দবন্ধ সলভ করছি, সব মিলে যাচ্ছে শুধু যেই শেষে পৌছোই, অংকটা মেলে না। কিরকম একটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিলো আমাদের দুজনকেই। চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার পাল্লাটা বন্ধ করতে যাব, ওমনি চোখ পড়লো আমার গল্পের খাতার ওপর। দমকা হাওয়ায় খাতাটা খুলে গেছে। যে লাইনটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো, তা দেখে আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। লাল কালিতে লেখা, 'নীলের লাল রক্তে ভেজা শরীরটা হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে রান্নাঘরে টেনে নিয়ে যেতে ঘাম ছুটতে লাগলো চন্দ্রানীর'। নীল, এই চরিত্র আমি কখন বুনলাম, আমি তো সবে..., কিছুই ভালো ঠেকছে না। "আপনি ওটা কি লিখছেন, গল্প! কৈ দেখি"। চন্দ্রানীর কৌতুহল ভরা প্রশ্নের উত্তরটা যতটা সম্ভব এড়িয়ে গিয়ে, কিছুটা থতমত হয়েই "না না, সেরকম কিছু না" বলে, খাতাটা বন্ধ করে, তার ওপর পেপারওয়েট চেপে বোল্লাম,
-"ওই আর কি, একদম পাতি কিছু একটা, দিনপঞ্জি বলতে পারেন। দুদিন লেখা হয়নি তাই ভাবলাম আজ লিখে ফেলি। বৃষ্টির জল এসে তো চা এর আমেজটাই মাটি করলো, যদি আরেককাপ চা হয় মন্দ হয় না, কি বলেন।"
-"একদম আমার মনের কথাটা বলেছেন। আর সাথে আপনার হাতের চায়ের স্বাধটাও নেওয়া হয়ে যাবে।"

নিরুপায় হয়েই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম, কিন্ত মনের মধ্যে ঘুরছে গল্পের খাতা। রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, আমার চায়ের সরঞ্জাম সব একদম ঠিক ঠিক জায়গায় সাজিয়ে রেখেছে চন্দ্রানী। এমনকি, চায়ের কেটল অবধি ধুয়ে তার যথাস্থানে রাখা। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ঠেকলেও, আপাতত এই বিষয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে দুকাপ চা বানিয়ে ফেল্লাম। দুকাপ চা বানিয়ে কাপে ঢালতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো, চায়ের কাপ দুটো এমনকি ট্রেটাও কোন সুযোগে যথাস্থানে রেখে গেছে চন্দ্রানী। আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো, যাতে আমার নাভিশ্বাস উঠলো। আমার বাটার নাইফ টা নেই। আমি মাঝে মধ্যেই জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখি বটে, কিন্তু সকালের ব্রেকফাস্টের পর সেটার ব্যবহার হয়নি। তবুও রান্নাঘরের চারিদিকে চোখ ফেরালাম, কিন্তু চোখে পড়লো না। ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে পারলাম না৷ তাড়াহুড়ো করে চায়ের কাপ দুটো ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই, চক্ষু চড়কগাছ। গল্পের খাতাটা খুলে তার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে, চোখ বোলাচ্ছে চন্দ্রানী। শিগগিরই ওর হাত থেকে খাতাটা বাজেয়াপ্ত করার উদ্দ্যেশ্যে "আরে ওতে কি দেখছো, কিসস্যু নেই সেরকম!" বলে হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো, খাতার পাতার ওপর লাল কলমে লেখা পাতাটা হাঁ করে খোলা। আমার দিকে ফিরে একটা বিকট স্বরে খিলখিলিয়ে হাসছে চন্দ্রানী। ডান হাতে ধরা আমার রান্নাঘর থেকে উধাও হওয়া বাটার নাইফ। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে, দুহাত দিয়ে বাটার নাইফটা কাড়তে গিয়ে, চায়ের ট্রেটা মাটিতে পড়তেই, তিব্র জ্বালায় আমার পাদুটো ঝলসে উঠলো। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই, হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সামনের দিকে।

হাতে একটি চিনচিনে ব্যাথায়, চোখ দুটো খুলতেই দেখি, হস্পিটালের বেডে শুয়ে। হাতে স্যালাইন চলছে। মাথা, তীব্র যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে। ঝাপসা চোখে দেখতে পাচ্ছি, আমার বাম দিকে, সাদা শাড়িতে একজন নার্স ইঞ্জেকশনের একটা সিরিঞ্জ থেকে ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে তাতে লেবেল সাঁটতে সাঁটতে বলছে, " ব্লাড টেস্ট রিপোর্টটা কাল সন্ধ্যে ছটার পর ডেসপ্যাচ থেকে কালেক্ট করে নেবেন।" হঠাৎ আমার ডান দিক থেকে ভিষণ চেনা একটা গলার স্বর ভেসে এলো, "আচ্ছা ঠিক আছে, আর ভয়ের কোনো কারণ নেই তো"! চোখ ফেরাতেই দেখি, আমার বৌ কৃত্তিকা।

Sunday, March 22, 2020

রোনালদো vs বালাক

 ১৯৯৮, স্কুলে যাওয়ার পথে লোকজনের কানাঘুষো শুনছি, এবারও ব্রাজিল। তখন থেকে বুঝেছি, ফুটবল বিশ্বে যতগুলোই দেশ থাক না কেন, ভারতের ফুটবল প্রেম পোলারইজড, পেলে আর মারাদোনার দলে। সে বছর অবশ্য জিনেদিন জিদানের জাদুতে ব্রাজিলকে ফাইনালে ধূর্মুশপেটা করলো ফ্রান্স। বুঝতে দেরি হয়নি, সমাজ, লোকজনের পোলারাইজেশন এর বাইরেও আরো অনেকটা বড়, আরো অনেক কিছু নিয়েই বাস্তব। এভাবেই আমার ফুটবলের ধারণা, অন্যান্য সব রকম ধারণা গড়া শুরু।

এরপর আমার ফুটবল খেলার দিনের শুরু। চুটিয়ে খেলেছি, রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, মাঠের শক্ত মাটি, কাকঁড়, সব উপেক্ষা করেই খেলেছি। ওই ছোট্ট বয়সেও নিয়মিত ভাবে, স্ট্রাইকার হিসেবে খেলি, রাইট উইং এ খেলি, মাঝমাঠেও খেলি। আমার চেয়ে অনেক বড় বড় ছেলেদের সাথে খেলি, গোল করি, অদম্য উৎসাহে তাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে ড্রিবল করি, ট্যাকল করি। 
 
২০০২ সালে আমার ফুটবল ধারনা অনেকটা পোক্ত। সেই বছরের বিশ্বকাপটার আমার কাছে অন্যতম, আমার দেখা প্রথম সম্পুর্ন বিশ্বকাপ বলা যায়। জাপান, সাউথ কোরিয়ার যৌথ আয়োজন, এশিয়ান দেশগুলোর ভালো প্রদর্শন, জমজমাট উত্তেজনা আর সর্বোপরি আবার ব্রাজিলের মাথায় তাজ। রোনাল্ডোর হিরোইজম, রোনালদিনহোর পায়ের জাদু, কার্লোসের বানানা কিক যেমন এখনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, সেরকমই ভেসে ওঠে মাইকাল বালাক, অলিভার কান দের চেহারাগুলোও। সময়ের সাথে দেশ কাল নির্বিশেষে ফুটবল হিরোদের উদ্ভব দেখেছি, আবার অনেক আশা জাগিয়ে মিলিয়ে যেতেও দেখেছি অনেককে। আর বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি, ভারত কবে এই দেশগুলোর সাথে বুক ঠুকে টেক্কা দেবে। সে ইচ্ছা আমার পূর্ণ হয়নি আজও।
 
টেক্কা দেওয়া ভালো তবে সেটা সঠিক সময়ে, আর সঠিক ময়দানে। স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স কে ভারত ফুটবলে টেক্কা দেবে এই আশা নেই, কিন্তু আজ ভারত যে ময়দানে এদের টেক্কা দিতে চলেছে, তা মোটেই যাচিত নয়। হ্যাঁ ঠিক বুঝেছেন, করোনা আক্রান্তের সংখ্যা যে রেটে এক সপ্তাহে ভারতে বেড়েছে, তা ইটালি, চিন, স্পেন কে পিছনে ফেলেছে। এভাবে বাড়তে থাকলে, আমাদের দেশের জনসংখ্যা আর মেডিকেল ইনফ্রাসট্রাকচারের কথা ভেবে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আক্রান্তের সংখ্যায় যতটা এগিয়ে, মৃতের সংখ্যায় আরও কয়েকগুন এগিয়ে যাব সন্দেহ নেই। ফুটবল মাঠে জেতাটা অনেক সহজ, মাত্র এগারো জনকে দলবদ্ধ ভাবে খেলতে হয়, আর এখানে গোটা দেশ, গোটা বিশ্ব, নানান মানুষ, নানান পরিস্থিতি, একটা নয়, হাজার হাজার কোচ, হাজার হাজার পদ্ধতি!
 
ফুটবল ময়দানে জিততে গেলে যেভাবে ডিফেন্সকে আঁটোসাটো করতে হয়, দলবদ্ধভাবে অপোজিশনের সামনা করতে হয়, আমাদেরও তাই করতে হবে। আমি কিছু সময় ডিফেন্সেও খেলেছি, বন্ধু মহলেই। হলফ করে বলতে পারি, ডিফেন্ডারের দায়িত্বটা অনেক অনেক বেশি। বন্ধু মহলে খেলেও নিজের দোষে দল হারলে, রাত্রে ঘুম হোত না। এত বড় একটা দেশ, প্রায় দেড়শ কোটি লোকের দায়িত্ব, হারলে আর শান্তিতে ঘুমোতে পারবেন কি! মনে রাখবেন, একজন দুর্বল ডিফেন্ডার পুরো দলটাকে হারিয়ে দিতে পারে। আর সেই দুর্বল ডিফেন্ডার হয়তো আপনি নিজেই। এত্ত বড় একটা হারের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে নিতে পারবেন তো, পারবেন তো ইটালির মত কফিন মোড়া রাস্তা বেয়ে দিব্যি হেঁটে যেতে, যেভাবে এখন যাচ্ছেন! আপনি রোনাল্ডোর মত হিরো হতে চান নাকি বালাকের মত, হয়তো বা ফাইনাল না খেলেই হারের তকমা নিয়ে বিদায় নেবেন তা সম্পুর্ণ আপনার হাতে, আমাদের সবার হাতে।

Monday, March 2, 2020

ফুটনোট

টুকরো ছেঁড়া স্বরলিপি, একঘেঁয়ে তাল, বেসুরো গান,
মেঘ জমা ওই আকাশ জুড়ে জমতে থাকে মান'ভিমান।
কাগজে মোড়া আকাশ কুসুম, ভাসিয়ে নিলো চোখের জল,
রঙিন খামে, শেষ চিঠিতে, ফিরিয়ে দিলাম, তাজমহল।


তির ছেড়েছে কাঠের ভেলা, বান উঠেছে, মাঝ সাগর,
ঝড়ের তোড়ে পাল ছিঁড়েছে, ছোট্ট নাও ও আধ পাগল,
সাগরপাড়ে আছড়ে পড়া টুকরো কাঠের বুক চিরে,
উঁকি মারে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন, ঢেউয়ের ভিড়ে।

শেষ স্তবকে গুছিয়ে রাখা আবেগ গুলোর আজ ছুটি,
কার্বনেটের অধঃক্ষেপে বুদবুদ ওঠে খুনসুটি,
মেঘ মল্লারে নির্ঘোষ ছাড়ে বারবার দুঃক্ষযাপন,
লাগাম ছেড়ে, বেয়াক্কেলে, আবার নতুন ভিৎস্থাপন।