Tuesday, November 3, 2020

আঙুল

ঝোপ জঙ্গলের ডালপালা ঠেলে, কাঁটা-পাথর উপেক্ষা করে প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে চলেছে মায়া। ভয়ে, ক্লান্তিতে চোখ মুখ লাল কালো ছোপে ভরে গেছে। পা দুটো ছড়ে রক্তাক্ত, তবুও হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় হিঁচড়ে নিজেকে টেনে নিয়ে চলেছে। ঘন্টা খানেক আগেই যে পরিস্থিতিটা সে পেরিয়ে এসেছে, ভাবতেই তার জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে। মাথার ওপর রোদের ছিঁটেফোঁটা যা ছিলো, কখন যে একরাশ ভয় উদ্বেগ মাখা অন্ধকারে পরিণত হয়েছে খেয়ালও করেনি। হাতের কব্জি ঘিরে লাল গোলাকার দাগ থেকে লাল রক্তের ফোঁটা চুঁইয়ে আঙুল বেয়ে সবুজের বুকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
সামনে এক বিশাল হাড়িকাঠ, একটা আস্ত মানুষ গলে যাওয়ার মত। চারিদিকে সব অদ্ভুত দর্শন, গাছের ডাল পাতা আবৃত, রঙ মাখা একদল জীব দুহাত তুলে লাফাচ্ছে আর কান ঝালাপালা করা শ্রুতিকটু শব্দে ভরিয়ে দিচ্ছে আকাশ, বাতাস, বাতাবরণ। মাথার একপাশের একটা টনটনে ব্যাথা আর হাতে পায়ে তীব্র জ্বালায় খেয়াল হলো, একটা মোটা দড়ি দিয়ে তার হাত পা একটা মোটা লম্বা কাঠের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে, আর তার সাথে আরো জনা তিন চারেক। ঝাপসা চোখে চারিদিকের ভয়াবহ রূপটা দেখে সারা শরীরে, রোমে রোমে আতঙ্কের পুঞ্জীভূত অ্যাড্রানালিন রাসটা গা বমি দিয়ে বেরিয়ে আসছে প্রায়। হঠাৎ তার আবছা দৃষ্টিতে পড়লো, হাড়িকাঠের ঠিক পাশে একটা ধড় থরথরিয়ে কাঁপছে, আর ফিনকি দেওয়া রক্তে ভরে গেছে তার চারপাশ। এরমধ্যে একজন ওই ধড়ের ডানহাতের কড়ে আঙুলটা পাথরের এক ঝটকায় কেটে একটা পাতায় মুড়ে কয়েকপা দূরের এক জ্বলন্ত আগুনের চাঁই এর মধ্যে ফেলে দিয়ে আবার দুহাত তুলে লাফাতে লাগলো। 
 
এরপর আর কিছুই খেয়াল নেই তার। তবে ঝোপ জঙ্গল বেয়ে সে ছুটে চলেছে, জনবসতি অঞ্চলে এসে না পৌঁছানো অবধি তাকে ছুটেই যেতে হবে, এ ব্যাপারে তার মনে একাংশও সন্দেহ নেই। মাঝে মধ্যে দূর থেকে সেই শ্রুতিকটু শব্দের হুল্লোড় কানে এসে পৌঁছাচ্ছে তার। হঠাৎ এক ঝটকায় কে যেন তার হাতটা ধরে টান মারলো। তীব্র জ্বালায় হাতটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। জ্বালা, ব্যাথা, ভয়, উদ্বেগের মধ্যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই, টানতে টানতে সোজা এক গুহার মুখে। এখনো চোখের দৃষ্টি ঝাপসা, তবে যে চেহারাটা চোখে পড়ছে, তা আর ‌যাই হোক ভয়ংকর নয়। একটা অদ্ভুত শান্তি আর শ্রান্তিতে আবার জ্ঞান হারালো মায়া।
 
টিমটিমে একটা আলো এসে পড়ছে চোখে। টনটনে যন্ত্রনায় মাথাটাও ভার। তবে খেয়াল করলো হাত, পায়ের জ্বালা, ব্যাথাটা এখন বেশ কম। চোখ খুলতেই এবার স্পষ্ট দেখতে পেলো সে একটা সুন্দর গোছানো ঘরের মধ্যে একটা নরম বিছানায় শুয়ে, আর তার সামনে, জ্ঞান হারানোর আগের সেই চেহারাটা। মুখে একটা স্মিত হাসি আর ডানহাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। হঠাৎ এরপর যেটা তার চোখ পড়লো, তা দেখে মায়ার সারা শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত খেলে গেলো, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনের ব্যাক্তিটির সিগারেট ধরা ডান হাতের কড়ে আঙুলটা, অর্ধেক, ঠিক মাঝখান থেকে কাটা।

No comments:

Post a Comment