Saturday, June 6, 2020

গল্পের নায়ক

আমার টেবিলটা বেস ছড়ানো ছেটানো। সামনের অর্ধেক ভর্তি চায়ের কাপের ঠান্ডা চা এর সাথে মিশে থাকা সিগারেটের ছাই তলিয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে। ধোঁয়ার গন্ধে ম-ম করতে থাকা আমার ছোট্ট ড্রয়িংরুমের চেয়ারে বসে, ভাবছি বেস খানিকক্ষণ। ল্যামির ফাউন্টেন পেন টা হাতেই নড়ে চলেছে অবিরত। প্রধান চরিত্রটা রচনা করতে বসে, সবে দুটো লাইন লিখেছি। লেখক হিসেবে এই প্রথম কোনো লেখক চরিত্রের পটভূমি লিখতে বেস কাঠ খড় পোড়াতে হচ্ছে বুঝতে পারছি। অ্যাশট্রে-র ওপোর রাখা মার্লবোরো সিগারেটটাও দেহ রেখেছে, সে অনেকক্ষণ হবে, খেয়াল নেই। আলতো হাতে আবার একটা লাইন লিখতে যাবো, হঠাৎ মাথাটায় কেমন একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠে, বন্ধ জানালার পাল্লা গুলো খুলে, আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে আবার এসে বসলাম টেবিলের পাশের চেয়ারটায়। মাথায় ঘুরতে থাকা বেস কিছু আইডিয়া এবার সন্তর্পণে লিখে ফেল্লাম খাতার ওপর। প্রধান চরিত্রর পটভূমিটা প্রায় তৈরি।

উত্তর কোলকাতার এক নাম না জানা ছোট্ট গলির মধ্যে প্রায় শয়েক মিটার ভেতরে এক ভাঙাচোরা ঘরের দোতলায় আমার বাস, প্রায় বছর তিনেক। এলাকাটা ঘিঞ্জি হলেও, নিচের তলা তো বাদই দিলাম, এই গলিতে আমি ছাড়া আর কেউ থাকে বলে এই তিনবছরে দেখিনি। প্রত্যন্ত পুরুলিয়ার এক গ্রাম থেকে কোলকাতায় এসে, এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের পড়ে থাকা বাড়িতে এসে মাথা গুঁজি। প্রথম প্রথম দু'একটা প্রাইভেট কম্পানিতে চাকরি করেছিলাম। কিন্তু তার সাথে লেখালিখিতে মোটেই সময় দিয়ে উঠতে পারতাম না। অগত্যা বছর খানেক আগে, চাকরি বাকরি ছেড়ে, লেখালিখিতে সম্পুর্ণ মননিবেশ করার কথা ঠিক করি। এই ঝুরঝুরে পোড়খাওয়া বাড়ির জন্য মাসের শেষে টাকা গুনতে হয়না, তাই একা মানুষ, ঠিক মানিয়ে নিচ্ছি।

আমার ড্রয়িংরুমটা আমার টেবিলের মতই ছড়ানো ছেটানো। খোলা জানালার পাশে একটু বাম দিক ঘেষে আমার টেবিল। জানালার ঠিক উল্টো দিকটায় আমার বসার চেয়ারটা রেখেছি। মাঝে মধ্যে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে যেতে বেস ভালো লাগে। এখন জানালার বাইরে দিয়ে যে আকাশটা দেখা যাচ্ছে তা পুঞ্জিভূত রোষ নিয়ে যেন ফুঁসছে, যে কোনো মুহুর্তে ফেটে পড়তে পারে। হোলোও ঠিক তাই। বাইরে থেকে একটা ঝিরঝির শব্দ কানে আসছে, আর সাথে মাঝে মধ্যেই গুড়গুড় শব্দও। বুঝলাম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হালকা বৃষ্টির ছাট এসে গায়েও লাগছে বলে মনে হোলো। আমার চোখ কিন্ত ঠায় আমার খাতায় লেখা লাইনগুলোর ওপর।

দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল এর শেষে সন্ধ্যে নামার মুখে। প্রধান চরিত্রটা বেঁধে সবে দ্বিতীয় চরিত্রটায় হাত দিয়েছি, হঠাৎ দরজায় একটা টোকা পড়লো। এই অসময়ে আমার দরজায় টোকা এই তিনবছরে একবার পড়েছিল, সেও প্রায় বছর দুই আগে। আমার ওই দূরসম্পর্কের আত্মীয় জানাতে এসেছিলেন যে তিনি বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এই বাড়ির সম্পুর্ণ দায়িত্ব আমার। তারপর আমার দরজায় টোকা দেওয়ার মত, আমার এই গলিতে থাকা বেড়াল, আর সকালবেলা দুধওয়ালা, লন্ড্রিওয়ালা আর খবরের কাগজওয়ালা ছাড়া আর কেউ নেই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আবার একবার টোকা, একই রিথমে। না বেড়াল নয়। লেখা নিয়ে বসেছি, চরিত্রটার বিভিন্ন লেয়ার কিভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় তা নিয়ে বিভিন্ন আইডিয়া মাথায় ঘুরছে, এর মধ্যে দরজায় টোকাটা বেস বিরক্তিকর ঠেকলো। ইতিমধ্যে আরো একবার, তবে টোকা নয়, প্রায় হাতের তালু দিয়ে ধাক্কা বল্লেই চলে। বেস বিরক্তি ও কিছুটা রাগের মাথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা খুলতে যাব ওমনি আরো একবার ধাক্কা। মাথার রগটা ইতিমধ্যে ফুলে উঠেছে, এক ঝটকায় দরজাটা খুলে রীতিমতো গালিগালাজ করতে যাব, হঠাৎ চোখে পড়লো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, প্রায় কাকস্নান করা এক যুবতি। আমি কিছু বলে ওঠার আগেই সে বোল্লো, "মাফ করবেন, এই বৃষ্টি বাদলের মধ্যে আটকে পড়ে গলিতে ঢুকে পড়েছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টিটা বেড়ে যাওয়ায় আপনার সিঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, কিন্তু সেখানে যেভাবে জল গড়াচ্ছে! একমাত্র আপনার জানালাটা খোলা দেখে, কিছুটা বাধ্য হয়েই দরজা ধাক্কালাম। যদি এই বৃষ্টির সময়টা একটু আশ্রয় পাওয়া যায় তো বাধিত হই। বৌদির কোনো শুকনো শাড়ি থাকলে একটু চেঞ্জ করে নিতে পারি, না হলেও চলবে, শুধু এই বৃষ্টির সময়টা যদি..."। আমি এমনিতেই মিতভাষী, মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে আবার একটু আমতা আমতাও করি, তার ওপোর এতগুলো কথা একটানা কতদিন পর শুনলাম, খেয়াল নেই। অগত্যা কিছুটা ইতস্তত হয়েই, মাঝপথে তার কথা থামিয়েই বোল্লাম, "ভেতরে আসুন"।

তারপর বেস খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। সে ঘরের ভেতরে আসতে আমি আমার একটা আলখাল্লা শুকনো জামা আর একটা কাচা ইস্তিরি করা ধবধবে সাদা পাজামা তার দিকে বাড়িয়ে, বিরক্তিকর নিরবতা কাটিয়ে বল্লাম, "মাফ করবেন, এখনও বৌদির জোগাড় করে উঠতে পারিনি, যদি এই জামাটায় কাজ চলে যায়, তাহলে পাশের ঘরটায় গিয়ে চেঞ্জ করে নিতে পারেন।" ভদ্রমহিলার চোখে মুখে ইতস্ততভাবটা স্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ডের ইতস্ততা কাটিয়ে আবার বল্লাম, "দরজার ছিটকিনিটা একটু সমস্যা করে, দরজাটা একটু জোরে টেনে ছিটকিনিটা লাগাবেন, আটকে যাবে"। এতগুলো কথা এক ঝটকায় বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেল্লাম। ইতিমধ্যে ভদ্রমহিলা সটান ভিতরঘরে গিয়ে দরজাটা এক ঝটকায় লাগিয়ে দিয়েছেন। বুঝলাম, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর আলুথালু চুল দেখে বয়সটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে আমার। আমি আবার আমার চেয়ারটা টেনে, হাতে কলম তুলে বসলাম।

কলমটা বেস চলছে হঠাৎ। দ্বিতীয় চরিত্রটা ফেঁদে গল্পের পটভূমি টা লিখতে সবে শুরু করেছি, হঠাৎ একটা শব্দে গল্পের জগৎ থেকে বাস্তবে এসে পড়লাম। আমার ছড়ানো ছেটানো ঘরে হাঁটাচলা করা আমি ব্যাতিত অন্য কারুর পক্ষেই বেস কষ্টকর। পেছন ফিরে দেখি, ভদ্রমহিলা আমার জামা আর পাজামা পরে, দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন। তার পায়ের সামনে গড়াগড়ি খাওয়া আমার একটা ঘটি থেকে জল পড়ে আমার মেঝেটা ভিজিয়ে দিয়েছে। আমি বিস্মিত হব, হাসবো নাকি রাগ দেখাবো বুঝে ওঠার আগেই, ভদ্রমহিলা বল্লেন, "মাফ করবেন, এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিনিসপত্র রাখলে তো এরকম হবেই। আমায় একটা শুকনো ন্যাকড়া দিন, আমি জলটা পরিস্কার করে দিচ্ছি। ও হ্যাঁ আমার নাম চন্দ্রানী।" রান্নাঘর থেকে একটা শুকনো ন্যাকড়া এনে তার হাতে দিতে দিতেই চড়াক করে মাথায় খেলে গেলো একটা ভাবনা, 'কি নাম, চন্দ্রানী!' ছুট্টে আমার টেবিলটায় গিয়ে চোখ বুলিয়ে দ্বিতীয় চরিত্রটার নাম খুঁজে দেখি, চন্দ্রানী। বর্ননাটা কিছুটা এরকম, 'মাঝবয়সি, আলখাল্লা জামা আর পাজামায় অভ্যস্ত বাম চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত এক সুঠাম যুবতি চন্দ্রানী। গ্রামে গঞ্জে গিয়ে দুস্থদের সেবা সুস্রুসায় ব্রতি এক এন.জি.ও -র সাথে বেশ কয়েক বছর যুক্ত।' তড়াক করে জিজ্ঞেস করে বসলাম, 'কি করা হয় আপনার!' মৃদু একটা হাসি ঠোঁটের কোণে টেনে এনে চন্দ্রানী বোল্লো, "তা গুছিয়ে বলতে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, চা খাবেন! আপনার টেবিলে চায়ের কাপ দেখে অনুমান করছি, রান্নাঘরে চা এর সরঞ্জাম সবই মজুদ আছে। আমার হাতের চা এর সবাই বেশ প্রশংসা করে, তার সাথেই নাহয় আমার কাজের ব্যপারটা খুলে বলবো। কি রাজি!" আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরলো না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই, চন্দ্রানী রান্নাঘরে চলে গেলো চা বানাতে। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম খাতাটার ওপর, লাইনটা জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে, 'তবে তার কাজের জন্য যতটা সমীহ সে দাবি করে, ঠিক ততটাই প্রসংশনীয় তার হাতের চা।'

তাহলে কি, আমার লেখা চরিত্রটা আমার চোখের সামনে ফুটে উঠছে! এতক্ষণ গল্পের প্রধান চরিত্রটা আমায় ভাবায়নি, কিন্তু এবার ভাবাচ্ছে। ল্যামির পেন, মার্লবোরো সিগারেট সব যেন এক্কেবারে মিলে যাচ্ছে। পেনটা খাতার মধ্যে রেখে, হুড়মুড়িয়ে বন্ধ করে দিলাম খাতাটা। মাথাটায় আবার কিরকম চিনচিনে একটা ব্যাথা। একটা সিগারেট বের করে ধরাতে যাবো ততক্ষণে চন্দ্রানী ট্রেতে করে চায়ের দুটো কাপ সাজিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ট্রে থেকে কাপ দুটো টেবিলে রেখে, আমার চেয়ারটা চন্দ্রানীকে ছেড়ে দিয়ে, আরেকটা চেয়ার টেনে বসলাম তার পাশেই। চায়ে চুমুক দিতে দিতে চন্দ্রানী বলতে শুরু করল, "আমি আসলে একজন নার্স, সামনের দুটো লেন ছেড়ে যে নার্সিংহোমটা আছে ওখানেই আমি কাজ করি।" শুনেই মন থেকে ভারটা যেন নেমে গেলো, যাক তাহলে এতক্ষন যা ভাবছিলাম সবটা নেহাতই কোইনসিডেন্টাল। আর স্বস্তির বিষয় হোলো গল্পের লেখক বিবাহিত, নাম রেখেছি রুদ্র। "ওহো খেয়ালই করিনি, শুধু শুধু চা খাচ্ছেন, দাঁড়ান কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসি", বলে খোস মেজাজে রান্নাঘর থেকে প্লেট সাজিয়ে বিস্কুট এনে রাখলাম টেবিলে। "আপনার নামটা কিন্তু এখনও জানা হোলো না" বলে উঠলো চন্দ্রানী। কিছুটা লজ্জান্বিত হয়েই বোল্লাম,
- "ইসসস দেখেছেন তো কি ভুলো মন, আমার নাম নীল।"
-"বাহ বেশ ভালো নাম, নীল, শিবের নাম। আমার ভাইয়ের নামও শিবের নামে রাখা, রুদ্র।"
আবার একটা খটকা, রুদ্র! আমার গল্পের লেখকের নাম! দুম করে আবার একটা প্রশ্ন করে বসলাম,
- "লেখালিখি করে!"
- "ভাই আর লেখালিখি, না না। আন্তপ্রনয়র এর কাজ করে, প্রধানত সফটওয়ার ডেভেলাপমেন্টের কাজ। আর সাথে ওই একটু আধটু ব্লগ লেখা, এই যা। বিয়ে থা করে এখন দিব্যি সংসার করছে। বৌ এর নাম কৃত্তিকা।"
- "আর আপনি, বিয়ে থা করেননি!"
-"না আসলে, আমি একটা এন.জি.ও. এর সাথেও যুক্ত। গ্রামে গঞ্জে গিয়ে দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে বেস খানিকটা সময় বাইরে বাইরেই কাটাতে হয়। বিয়ে থা এর ব্যাপারে ভেবে ওঠারই অবকাশ পাইনি।"

সব যেন কিরকম গুলিয়ে যাচ্ছে। যেন এক শব্দবন্ধ সলভ করছি, সব মিলে যাচ্ছে শুধু যেই শেষে পৌছোই, অংকটা মেলে না। কিরকম একটা দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দিলো আমাদের দুজনকেই। চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার পাল্লাটা বন্ধ করতে যাব, ওমনি চোখ পড়লো আমার গল্পের খাতার ওপর। দমকা হাওয়ায় খাতাটা খুলে গেছে। যে লাইনটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো, তা দেখে আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। লাল কালিতে লেখা, 'নীলের লাল রক্তে ভেজা শরীরটা হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে রান্নাঘরে টেনে নিয়ে যেতে ঘাম ছুটতে লাগলো চন্দ্রানীর'। নীল, এই চরিত্র আমি কখন বুনলাম, আমি তো সবে..., কিছুই ভালো ঠেকছে না। "আপনি ওটা কি লিখছেন, গল্প! কৈ দেখি"। চন্দ্রানীর কৌতুহল ভরা প্রশ্নের উত্তরটা যতটা সম্ভব এড়িয়ে গিয়ে, কিছুটা থতমত হয়েই "না না, সেরকম কিছু না" বলে, খাতাটা বন্ধ করে, তার ওপর পেপারওয়েট চেপে বোল্লাম,
-"ওই আর কি, একদম পাতি কিছু একটা, দিনপঞ্জি বলতে পারেন। দুদিন লেখা হয়নি তাই ভাবলাম আজ লিখে ফেলি। বৃষ্টির জল এসে তো চা এর আমেজটাই মাটি করলো, যদি আরেককাপ চা হয় মন্দ হয় না, কি বলেন।"
-"একদম আমার মনের কথাটা বলেছেন। আর সাথে আপনার হাতের চায়ের স্বাধটাও নেওয়া হয়ে যাবে।"

নিরুপায় হয়েই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম, কিন্ত মনের মধ্যে ঘুরছে গল্পের খাতা। রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, আমার চায়ের সরঞ্জাম সব একদম ঠিক ঠিক জায়গায় সাজিয়ে রেখেছে চন্দ্রানী। এমনকি, চায়ের কেটল অবধি ধুয়ে তার যথাস্থানে রাখা। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ঠেকলেও, আপাতত এই বিষয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে দুকাপ চা বানিয়ে ফেল্লাম। দুকাপ চা বানিয়ে কাপে ঢালতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো, চায়ের কাপ দুটো এমনকি ট্রেটাও কোন সুযোগে যথাস্থানে রেখে গেছে চন্দ্রানী। আরেকটা জিনিস চোখে পড়লো, যাতে আমার নাভিশ্বাস উঠলো। আমার বাটার নাইফ টা নেই। আমি মাঝে মধ্যেই জিনিসপত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখি বটে, কিন্তু সকালের ব্রেকফাস্টের পর সেটার ব্যবহার হয়নি। তবুও রান্নাঘরের চারিদিকে চোখ ফেরালাম, কিন্তু চোখে পড়লো না। ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে পারলাম না৷ তাড়াহুড়ো করে চায়ের কাপ দুটো ট্রেতে সাজিয়ে নিয়ে রান্নাঘর থেকে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই, চক্ষু চড়কগাছ। গল্পের খাতাটা খুলে তার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে, চোখ বোলাচ্ছে চন্দ্রানী। শিগগিরই ওর হাত থেকে খাতাটা বাজেয়াপ্ত করার উদ্দ্যেশ্যে "আরে ওতে কি দেখছো, কিসস্যু নেই সেরকম!" বলে হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়লো, খাতার পাতার ওপর লাল কলমে লেখা পাতাটা হাঁ করে খোলা। আমার দিকে ফিরে একটা বিকট স্বরে খিলখিলিয়ে হাসছে চন্দ্রানী। ডান হাতে ধরা আমার রান্নাঘর থেকে উধাও হওয়া বাটার নাইফ। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে, দুহাত দিয়ে বাটার নাইফটা কাড়তে গিয়ে, চায়ের ট্রেটা মাটিতে পড়তেই, তিব্র জ্বালায় আমার পাদুটো ঝলসে উঠলো। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই, হুমড়ি খেয়ে পড়লাম সামনের দিকে।

হাতে একটি চিনচিনে ব্যাথায়, চোখ দুটো খুলতেই দেখি, হস্পিটালের বেডে শুয়ে। হাতে স্যালাইন চলছে। মাথা, তীব্র যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে। ঝাপসা চোখে দেখতে পাচ্ছি, আমার বাম দিকে, সাদা শাড়িতে একজন নার্স ইঞ্জেকশনের একটা সিরিঞ্জ থেকে ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে তাতে লেবেল সাঁটতে সাঁটতে বলছে, " ব্লাড টেস্ট রিপোর্টটা কাল সন্ধ্যে ছটার পর ডেসপ্যাচ থেকে কালেক্ট করে নেবেন।" হঠাৎ আমার ডান দিক থেকে ভিষণ চেনা একটা গলার স্বর ভেসে এলো, "আচ্ছা ঠিক আছে, আর ভয়ের কোনো কারণ নেই তো"! চোখ ফেরাতেই দেখি, আমার বৌ কৃত্তিকা।

1 comment: