দুমড়ে মুষড়ে পড়েছিল সময়। কার্ভড স্পেস টাইম এর ফাঁকে ফাঁকে গাঁথা ছিল যন্ত্রণা। দেখা শোনা বোঝার বাইরে অন্য কোনো ডাইমেনসনে লুকিয়ে ছিল, লুকিয়ে আছে ও থাকবে, সব। রোজ সকালের আধসেঁকা পাউরুটির বুকে ছিদ্রে ছিদ্রে লুকিয়ে থাকা বাতাসের খোঁজ কেও রাখে না। মাখন বা জ্যাম এর প্রলেপ দিয়ে সেই যন্ত্রণা আমরা রোজ গিলছি।
দশটা বাজে। ফোনটা এখনও এলো না! হাঁসফাঁস করছে বুকটা। দুটুকরো বাদাম এর সাথে একটা পেগে চুমুক বসাতে বসাতেও মনটা ডুকরে উঠছে। দুতিনবার হাতটা ফোনের কল বাটনটা টিপতে গিয়েও ফিরে এলো। আরো কিছুটা সময় দেখি। সঙ্গে আরেক পেগ। তারপর কখন নেশায় ডুবে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। সেই ফোনের অপেক্ষা আর শেষ হয়নি। কার্ভড স্পেস টাইম এর ফাঁকে কোনো এক প্যারালাল ইউনিভার্স-এ হয়তো ফোনটা এসেছিল। সকালে উঠে আধসেঁকা পাউরুটির ওপর জ্যাম এর প্রলেপ দিয়ে গলাদ্ধকরন। তারপর আবার যেই কে সেই।
পরীক্ষাটা বেশ ভালই হয়েছিল। নিজের নামটা সিলেক্টেড ক্যান্ডিডেটদের তালিকায় দেখে মনের আনন্দটা ধরে রাখতে পারিনি। রোজ সকালে বাবাকে বেরিয়ে যেতে দেখি, ছেঁড়া একটা জামা আর ময়লা একটা প্যান্ট পরে। দুপুরে, রাতে খেতে বসে কোনদিন ভাবিনি আজকের খাবারটা কিভাবে জোগাড় হোল। সেই বাবা যখন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এতদিনের জমানো চোখের জলে আমার জামাটা ভিজিয়ে দিল, সেদিন আমার সমস্ত পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়েছিল। তারপর থেকে জয়েনিং লেটারটার অপেক্ষায় আছি। দিন গেল, মাস গেল, বছর গেল। আমার কতশত বন্ধু চাকরি পেল। আমি অপেক্ষায় এখনও। সকালে উঠে আধসেঁকা পাউরুটির ওপর জ্যাম এর প্রলেপটা আর কতদিন দিতে পারব জানিনা। তারপর তো উন্মোচিত হবেই, পাউরুটির বুকে ছিদ্রে ছিদ্রে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা। তবু আজকের মত পাউরুটির ওপর জ্যাম এর প্রলেপ দিয়ে গলাদ্ধকরন। তারপর আবার যেই কে সেই, অপেক্ষা। সম্ভাবনাময়তার মায়া কাটিয়ে কোনো এক প্যারালাল ইউনিভার্স-এ হয়তো জয়েনিং লেটারটা পৌঁছেছিলো আমার হাতে।
সকাল দশটায় প্রেজেন্টেশান। স্নান খাওয়া সেরে আমি তৈরি। কিন্তু বৃষ্টিটা যেন হার মানতে চায় না। আমার এত বছরের সমস্ত পরিশ্রমের মর্যাদা পাওয়া না পাওয়া সব আজকের প্রেজেন্টেশানের ওপর। আধসেঁকা পাউরুটির ওপর জ্যাম এর প্রলেপ দিয়ে কয়েক কামড় দিয়ে বৃষ্টি ভিজেই স্টেশনে পৌঁছলাম। "ক্রিপয়া ধ্যান দে, বারিশ কে কারণ ইস লাইন কি সারি ট্রেনে বন্ধ হ্যাঁয়। প্রতিকশা করে, ট্রেন-এ চালু হোনে পে সুচিত কিয়া যায়েগা।" তারপর অপেক্ষা, সাথে বৃষ্টি আর চোখের কোনে জমতে থাকা, ঘাম না জল, কি যেন একটা। কার্ভড স্পেস টাইমের অবাধ্যতার শিকার হলাম আবার। কোনো এক প্যারালাল ইউনিভার্স-এ হয়তো ট্রেনটা সময়মত এসেছিল।
ব্রেকফাস্টের টেবিলে সামনে প্লেটটা টেনে বসলাম,আধসেঁকা পাউরুটিটা আর পাশে জ্যাম এর শিশি । রানু ছুটে এসে বলল, ছাদে কাপড়গুলো মেলে এসেই দিচ্ছি, একটু অপক্ষা কর, বলেই ছুটে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে। বেচারি সারা সকাল কাজের চাপে নাস্তানবুদ। তবু রানুর হাতের মাখানো জ্যাম না হোলে আমি পাউরুটিটা খেতে পারিনা । তাই অপেক্ষায় আমার সমস্যা নেই। হঠাৎ একটা ধপাস শব্দ, সঙ্গে তীব্র আর্তনাদ। সঙ্গে সঙ্গে জ্যামের প্রলেপ দেওয়ার অভ্যাসের সমাপ্তি। আর শুরু অপেক্ষার। হয়ত অন্য কোন প্যারালাল ইউনিভার্স-এ আমি রানুকে বলেছি, আজ তুমি একটু রেস্ট নাও আমি জামাকাপড় গুলো মেলে দিয়ে আসি।
হঠাৎ মাথার মধ্যে বীভৎস একটা শব্দ হতে লাগলো, অবিরাম, বিরক্তিকর। কান ঝালাপালা হয়ে যেতে লাগলো, মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগলো। একটা টনটনে ব্যাথা ক্রমশ মাথা থেকে কপালে, চোখে ছড়িয়ে পড়ছে। আর টাল সামলাতে না পেরে শরীরটা হাওয়ায় ভেসে গেল, মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়তেই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুমটা ভেঙে গেলো। অ্যালার্ম ঘড়িটা তখনও বেজে চলেছে। সূর্য্যের আলোটা সোজা জানালা দিয়ে চোখে এসে পড়েছে। হয়তো কোনো এক প্যারালাল ইউনিভার্সে এগুলো একটাও স্বপ্ন নয়! রানু চা এর কাপটা টেবিলে রেখে বোলে গেলো, "অনেক বেলা হোলো উঠে পড়ো, অামি জামা কাপড় গুলো মেলে দিয়ে আসি ছাদে।"
No comments:
Post a Comment