Friday, January 8, 2016

AWEসাধারণ

ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি, ওপরের ওঠার পথটা নাকি কঠিন! কিন্তু এতগুলো বছর পেরিয়ে, স্কুল কলেজ এর গণ্ডি মাড়িয়ে এলাম, কেও কোনদিন বলে দিল না যে পথটা যতটা কঠিন তার চেয়েও বেশী পঙ্কিল। অবশ্য ছোটো বেলায় এটাও শুনেছি যে পদ্ম পাঁকে ফোটে। কিন্তু এই দুটি কথা যে একসাথেও অর্থপূর্ণ হতে পারে সেটা অভিজ্ঞতাই শিখিয়েছে।

প্রত্যেকেই চায় তার সন্তানসন্ততি বড় হয়ে উঠুক, সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠুক, কারণ তারা তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই করে বুঝেছেন, সাধারণ এর কোন মূল্য নেই। সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ হওয়ার দৌড়টা যে কতটা একতরফা তা সেই দৌড়ে সামিল না হলে বোঝাটা কঠিন। জন্মের সাথে সাথে যে সাধারণ কিম্বা অতিসাধারণের তকমা সেঁটে দেওয়া হয় একটা বাচ্চাকে তার সার্বিক পারিপার্শ্বিক এর পরিপ্রেক্ষিতে, যার জন্য আদৌ সে দায়ী নয়, সেই তকমাটা তার জীবন ধারণের পরিপন্থী না হলে যে পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয় সেই সাধারণ কিম্বা অতিসাধারণ এর ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে, সেটা অপরিকল্পনীয়। আর যারা অসাধারণের ট্যাগ নিয়ে এ জগতে অবতরণ করে তাদের কাছে দুনিয়া একটাই, সেখানে সাধারণ বা অতিসাধারণের কোন জায়গা নেই। তাই জন্মানোর আগে আমি একজন রাজনীতিবিদ, চিত্রাভিনেতা কিম্বা ক্রিকেটারের ঘরের দুলাল হব, এই অভিলাষ প্রকাশের সুযোগটা বোধহয় সৃষ্টিকর্তার টেবিলে থাকা উচিৎ। অবশ্য এটা ভেবে বসার কোন কারণ নেই যে আমি সৃষ্টিকর্তা ভগবানে বিশ্বাসী। এতদিন ধরে মানুষের মধ্যে থেকে মানুষকেই বিস্বাস করে উঠতে পারলাম না! যাইহোক, মুল কথায় ফেরা যাক। তা সেই পঙ্কিল ঘোলা জলে সন্তরণে যারা সিদ্ধহস্ত, যারা পাঁকের মধ্যে কমলের সন্ধান পেয়েছেন বলে আমাদের ধারনা, তাদের লেজটা খুঁজে সেটা আঁকড়ে ধরে ভেসে বেড়ানো লোকের সংখ্যাটাও নেহাতই কম নয়। মাঝে মধ্যে মোটা লেজকে সতেজ ও সবল রাখতে তেল-মাখন ইত্যাদি দ্বারা মর্দন করে দেওয়াটা এদের কাছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ভুল ভাবার অবকাশ নেই, সন্তরণের জন্য লেজটা অত্যাবশ্যক। আর যারা সন্তরণ কিম্বা লেজে তেল-মাখন মাখানোর স্বাভাব কোনটাই আয়ত্তে আনতে পারেনি তাদের জীবনের মূল্য লোকাল বাস এর টিকিট এর মতন, যতক্ষণ বাসে আছে ততক্ষণ হাতবদল আর তারপর তো চেবানো chewing gum ও এর চেয়ে বেশী দামি। সে যা করেই হোক, একবার ওপরে উঠে যেতে পারলেই যে কেল্লা ফতে, এই ধারনা নিয়ে যারা ঝড়-বৃষ্টি-কাদা-পাঁক উপেক্ষা করে, লেজ ধরে কিম্বা মইয়ে ভর করে ওপরের দিকে উঠে চলেছে, যাদের দিকে তাকিয়ে নিচের মানুষগুলো ভাবে কি সুখেই না এরা ওপরের সিঁড়িটায় দাঁড়ীয়ে, তাদের অবস্থাটা অনেকটা ছেঁড়া টাকার মত, ফেলেও দেওয়া যায় না আবার ব্যাবহার উপযোগী ও নয়, শুধু ভরসা সরকার। আর রাস্তাটা অনেকটা সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ীয়ে দেখতে পাওয়া দিগন্তের মত। পাড় থেকে বেশ সুন্দর দেখায়, মনে হয় একবার সমুদ্রে ঝাঁপ দিলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে দিগন্তে আর তারপর সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত হবে আমার নিয়ন্ত্রণে। যারা সাঁতার জানে না তাদের ধারনা যারা সাঁতার জানে তারা কি সৌভাগ্যবান। আর যারা নিজের সন্তরণশৈলীর ওপর ভরসা রেখে পাড়ের সাঁতার না জানাদের সাবাসি নিয়ে একবার ঝাঁপ দিয়েছে শুধু তারাই জানে, না আছে ফেরার পথ আর না আছে কোন গন্তব্য।

এই পর্যন্ত পড়ে যদি মনে হয়ে থাকে যে আমি একজন সমালোচক তাহলে আপনি যথার্থই ভাবছেন শুধু এটুকু যোগ করব যে সমালোচনার শেষটা যাতে আশাবাদী হয় সেই চেষ্টায় ত্রুটি রাখব না।  সুতরাং প্রশ্ন হোল, তাহলে উপায় কি! উত্তরটাও সর্বজনবিদিত। যদি সাধারণ মানুষ এর ছাপ নিয়ে এসেছেন তাহলে ভগবান আপনার সহায়, কারণ সাধারণ মানুষ আপনার প্রতিযোগী আর অসাধারণ মানুষদের কাছে আপনার কোন অস্তিত্ব নেই, যদি না তার কালো টাকার সদ্গতি করার সময় উপস্থিত হয়ে থাকে। এককথায় নিরুপায় এবং একা। তবে ফাটকা খেলতে ছাড়বেন না। একমাত্র ফাটকাই আপনাকে শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে কারণ একমাত্র এটাই নিরপেক্ষ। ফাটকার অভাব নেই এ দুনিয়ায়। ধর্ম, জ্ঞান-বিজ্ঞান, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে জাতি, নিয়ম-কানুন, সবই আজকাল ফাটকা। এসব দিয়েও যদি কিছু না করে থাকতে পারেন, একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া আপনাকে দেখার কেও নেই এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন ততই দেশের, দশের ও দাসের মঙ্গল। আর যদি ফাটকায় বিশ্বাস না রাখেন, নিজের ওপর আস্থা রাখা ছাড়া উপায় কি। একবার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, আমরা কেন জন্ম থেকেই হাঁটতে পারি না, কেন হামাগুড়ি দিয়ে, আছাড় খেয়ে শিখতে হয়। ভেবে দেখলাম, প্রকৃতি আমাদের ছোটবেলাতেই সাবধান করে দিয়েছে, ওপরের দিকে তাকিয়ে পথ চললে হোঁচট খেতে হয়। তাই প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কিছু করা, নইব-নইব-চ। প্রকৃতির নিয়মে আমরা ডানাবিহীন প্রাণী। পাখি দেখে ওড়ার সখ জাগাটা স্বাভাবিক, তবে কাঁকড়ার গল্পটাও যদি শোনা না থাকে তাহলে একটু মনে করিয়ে দেওয়াটা আমার কর্তব্য।

লোকাল ট্রেনে এক কাঁকড়া ব্যবসায়ি এক গামলা জ্যান্ত কাঁকড়া নিয়ে উঠেছেন। ভিড় ট্রেন, অথচ গামলার মুখটা হাঁ করে খোলা। কিছু কাঁকড়া গামলার গা বেয়ে ওপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করছে। সেই দেখে, কিছুটা ভয় আর কিছুটা  উদ্বেগ এর বশবর্তী হয়ে এক সহযাত্রী বলেই ফেললেন, 'দাদা আপনার কাঁকড়ার গামলা টা যে খোলা, কিছু কাঁকড়া তো গা বেয়ে উঠেও আসছে। বেরিয়ে পড়বে তো!'  ব্যবসায়ি শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, 'চিন্তার কোন কারণ নেই দাদা, এগুলো মানুষ-কাঁকড়া, দেখছেন না, একজন গা বেয়ে উঠছে অমনি আরেকজন তাকে টেনে নামিয়ে দিচ্ছে।'

সুতরাং মানুষ যতদিন এই সহজাত প্রবৃত্তিকে জয় না করছে, ডানাটা না হয় পাখিরই থাক।

আপনাদের কতটা খুশী করতে পারলান জানিনা, তবে তোষামুদে মানুষদের খুশী করাটা আমার স্বভাব বহির্ভূত। তাই আপাতত এখানেই ইতি টানছি। 

No comments:

Post a Comment