যদিও শীতকালে ঝপ করে সন্ধ্যে নামে, আজ এখনো সন্ধ্যে নামতে বেশ খানিকটা সময় আছে। সবে সূর্যের বুকে লালিমা দেখা দিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে আরেকবার নিজের ফুলবাগানের তদারকি করে নিচ্ছে সুমনা। রঙ বেরঙের গোলাপ, ডালিয়া, চম্পা, প্যানসি, জিনিয়া তে ভরপুর এই বাগানটা সুমনা আর সুজন একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে গড়ে তুলেছিল, সে প্রায় বিশ বৎসর আগে, আর সাথে সংসারটাও। সূর্যের লালাভ আলোয় সুমনাকে নাকি সোনালি চন্দ্রমল্লিকার পাপড়ির মত দেখায়। তাই বাগানের একপাশে, সন্ধ্যে নামলে যেখানে সূর্যের আলো শেষ বারের মত আঙুল বুলিয়ে যায়, সেখানে শুধু চন্দ্রমল্লিকার স্থান। রোজ সন্ধ্যে হলে সুমনাকে এই ফুলগুলোর মাঝে বসিয়ে মন ভরে দেখতো আর হারিয়ে যেত সুজন। এখন নিজের হাতে সমস্ত বাগানটা সামলে রেখেছে সুমনাই, আর সাথে সংসারটাও।
অন্ধকার নামতে দেখে, আজকের মত শেষ বার চন্দ্রমল্লিকাগুলোর বুকে হাত বুলিয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো সুমনা। 'সুমনা, হয়ের ইস মাই ফ্লোরেসেন্ট ব্লু টাই! আই নিড ইট, ইটস অ্যান ইমপর্ট্যান্ট ক্লায়েন্ট মিটিং, অ্যা বিগ বিগ ওয়ান'। সুজনের এমন দাবিদাবায় সুমনা এখন অভ্যস্ত। 'দিচ্ছিইইই', বলে বেডরুম থেকে ফ্লোরোসেন্ট ব্লু টাই এনে সুজনের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস কোরলো, ' ডিনারে কি খাবে আজ!'। টাই-টা গলায় জড়াতে জড়াতে, 'উই হ্যাভ অ্যা বিজনেস ডিনার টুনাইট উইদ আওয়ার ফরেইন ক্লায়েন্টস, সো ওয়েট কোরো না, খেয়ে নিয়ো, আই মাইট বি লেট', বলে দরজার দিকে পা বাড়ালো সুজন।
সে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা যখন সুমনা সুজনের কোম্পানি তে ট্রেইনি হিসেবে জয়েন করে। বেশ সুন্দর দেখতে ছিল সুমনাকে। টানা টানা চোখ, নির্মল হাসি, আর তার সাথে বুদ্ধিদীপ্ত চালচলন ও প্রাণবন্ত স্বভাবের জন্য খুব সহজেই মন জয় করে নিতে পারতো। মিশুকে, স্মার্ট এবং অফিসিয়াল ম্যাটার সামলাতেও বেশ দক্ষ হওয়ায় দ্রুত উন্নতিও করতে থাকে। তার উন্নতি চোখ এড়ায়নি কোম্পানির হর্তাকর্তাদের। অগত্যা কিছুদিনের মধ্যেই সুজনের আন্ডারে একটা বড় প্রোজেক্টের লিড হয়ে যায় সুমনা। সেই প্রোজেক্টের সাক্সেস পার্টি তে, আজকের দিনেই নাটকিয় ভাবে হলভর্তি লোকের সামনে হাঁটু মুড়ে, হাতে গোলাপ আর ডাইমন্ড রিং নিয়ে সুমনা কে প্রোপোজ করেছিল সুজন, ঠিক একুশ বছর আগে। আর তার ঠিক একবছর পর, টু মেক দি ডে মেমোরেবল, প্ল্যান করেই আজকের দিনে সাত পাকে বাঁধা পড়েছিল তারা।
এখন সুজন বড্ড কেরিয়ার সেন্ট্রিক, শুধু সাক্সেস আর সাক্সেস। সারাক্ষন সাক্সেস এর পেছনেই ছুটে চলেছে। আর সৌভাগ্যক্রমে এখনো অবধি ফেলিওর এর মুখ দেখতে হয়নি তাকে। তাই সুমনার জন্যও তার কাছে আর সময় নেই। হয়তো তখন সুমনাও তার জন্য একটা অ্যাচিভমেন্টই ছিল মাত্র, যেটাকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিলো সুমনা। বিয়ের দুবছরের মাথায় সংসারের জন্য চাকরি ছাড়ার পর তার আর নিজের জন্য বাঁচা হয়ে ওঠেনি। সব কিছু মেনে নিয়ে নিজের মত করে নিজেকে, নিজের ভালোলাগা গুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছে সুমনা। সময় মত নিজের ভালোলাগার বাগানে রোদ জল বাতাস নিজের মত করেই খেলিয়ে নেয় সে।
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টেলিফোনটা ডায়াল করলো সুমনা, 'হ্যালো, ইস দিস দি গ্রিন চিলিস মাল্টিকুইসিন রেস্তোরাঁ!... ওকে, ক্যান ইউ প্লিজ সেন্ড মি দি শেফস স্পেসাল ইন্ডিয়ান কুইসিন ইউ হ্যাভ ইন নন-ভেজ উইথ দি বেস্ট অ্যাভেলেবল ব্রেড উইদ অ্যা পিঞ্চ অফ বাটার।... থ্যাংকস, প্লিজ নোট মাই অ্যাড্রেস....'। অর্ডারটা আসতে সময় লাগলো ঘন্টাখানেকের কিছু বেশীই। তার মধ্যে, পরিপাটি করে লাল বেনারসি পরে, লাল টিপ আর লিপস্টিপ লাগিয়ে, গায়ে সুগন্ধি ছড়িয়ে, বিশ বছর পুরোনো ওয়াইনের বোতলটা ডাইনিং টেবিলে নামিয়ে রাখলো সে। ডাইনিং টেবিলের মধ্যেখানে একটা ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে দিতেই মিটমিটে একটা সোনালী আলোয় ঘরটা মায়াবী হয়ে উঠলো। এভাবে নিজের সাথে নিজেই সেলিব্রেট করতে শিখে গেছে সুমনা, অনেক বছর হোলো।
দরজার বেল বাজলো, খাবার এসে গেছে হবে, এই ভেবে, দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সুমনা। দরজা খুলতেই চমকে উঠলো সে। সুজন দরজার বাইরে হাঁটু মুড়ে, হাতে একগোছা চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে বসে। সুমনার দিকে ভেজা ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো, ' উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন্টাইন ফর দি রেস্ট অফ আওয়ার লাইফ!' সুজনের এহেন কাতর মিনতিপূর্ণ গলা আর ছলছল চোখ সুমনার একদম অচেনা। সুজনদের কোম্পানি ব্যাঙ্করাপ্ট ঘোষণা করা হয়েছে। আজকের মিটিঙের সাক্সেসের ওপর টিকে ছিলো সমস্ত আশা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ঘরের টিমটিমে মায়াবী আলোয় যেন সমস্ত সুখ দুঃখ, চাওয়া পাওয়া, সাক্সেস ফেলিওর এক ধাক্কায় মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। এক সোনালী ভবিষ্যতের অঙ্গীকার নিয়ে আবার হাতে হাত রেখে চলার স্বপ্ন দেখার শুরু সেদিনের খাবার একসাথে ভাগাভাগি করে খাওয়া দিয়ে। সাথে তাদের বিয়েতে পাওয়া ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আবার নতুন করে সোনালী চন্দ্রমল্লিকায় হারিয়ে যেতে লাগলো সুজন।