Tuesday, June 28, 2016

আত্মীয়তা

তাকিয়ে দেখো, আলোর শহর, আঁধার ঘরে ঘরে, হাল্কা দোলায় শিরদাঁড়াটাও ভীষণ রকম নড়ে। কাঁপতে থাকে রঙের মিছিল গন্ধকেরই সাজে, মুখোস ঢাকা সুপ্ত বদন ডুব দিয়েছে লাজে।
আপন পরের হিসেব যাদের চারদেওয়ালে মোড়া, লাগাম ছাড়ো, পালিয়ে বাঁচুক, আত্মীয়তার ঘোড়া। গুনতে পারো, কলম চালাও, মেলাও দেখি দেনা, মেকি হাসির বদান্যতা আর নেওয়া যাচ্ছেনা।
কুলুপ আঁটা গলার নিচে জমতে থাকা রোষ, দিনদুপুরে ঢিল মেরে যায়, অবাধ আক্রোশ। আড়াল করো লোকদেখানি এসব চেনাজানা, পানা পুকুরে ধরছে পচন, বিষাক্ত যন্ত্রণা।

Saturday, June 25, 2016

প্রেম

ধৃষ্টতা আজ তোমার ঠোঁটের ছোঁওয়া,
ধৃষ্টতা আজ তোমার আলিঙ্গন,
ধৃষ্টতা আজ মনমালিন্য ভুলে
প্রেমের সলিলে বাঁধ ভাঙা বর্ষণ।

পেলবতা আজ তোমার মুখের হাসি,
পেলবতা আজ তোমার চোখের জল,
পেলবতা আজ তোমার শাড়ির ভাঁজে,
লুকিয়ে থাকা মনখারাপের ঢল।

স্নিগ্ধতা আজ তোমার শরীর বেয়ে,
স্নিগ্ধতা আজ তোমার স্পন্দন,
স্নিগ্ধতা আজ একাকিত্বের রাতে,
তোমার আমার অটুট বন্ধন।

Friday, June 24, 2016

সমান্তরাল সরলরেখা

ইংরাজরা দেশছাড়া হয়েছে, সে হোলো প্রায় কয়েক দশক। কিন্তু তারা তাদের পেছনে ফেলে গেছেন তাদের থাকাখাওয়া, চালচলন, আদবকায়দা, পোশাকআশাক, আচার ব্যবহার, আরো কত কি। তবে মাথাব্যাথার কারণ হোলো তাদের আমলের চিরপরিচিত প্রজাতি, মাছি মারা কেরানি, যারা, ইংরাজরা চলে যাওয়ার এতদিন পরেও স্বমহিমায় বর্তমান। না এনারা আজকাল আর মাছি মারেন না কিম্বা কেরানিগিরিও করেন না হয়তো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কুঠুরিতে বোসে জোয়ান চেবান আর বাতেলা দেন। তবে এতে তেনাদের ঐতিহ্য বিন্দুমাত্রও খর্ব হয়না। আজও প্রভু আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে এনাদের জুড়ি মেলা ভার। রাজার মাথার ব্যামো, ওনার ইচ্ছে রাজ্যের প্রজারা সকলে নিজের নিজের মাথায় পাখির ইয়ে মর্দন করুন, তাতে রাজার ব্যামো সারলেও সারতে পারে। ব্যাস ওমনি কেরানির দল সারা রাজ্যের পাখির ইয়ে সংগ্রহে লেগে পড়লেন। এতে দেশের দশের কি লাভ তাতে তাদের কিসসু যায় আসে না।
এনাদের চক্ষু কর্ণ দৃশ্যমান হোলেও তা ব্যবহারের অভাবে নিতান্তই অকার্যকরি। মানুষের ব্যবহার উপযোগী যা কিছু সবই এনাদের অলঙ্কার মাত্র, যা স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে রাজার পায়ে সমর্পণ করতে এনারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। রোজ সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে এনারা এনাদের মগজ বাক্সবন্দি করে তালা লাগিয়ে নিয়ে এসে রাজার দরবারে জমা দেন। রাজার হুকুম মত সমস্ত বাক্সবন্দি মগজ পুকুরের জলে ফেলে দেওয়া হয়। বাড়ি ফেরার পথে এনারা পুকুরে ডুব দিয়ে এক একটি বাক্স তুলে বাড়ির পথে হাঁটা লাগান। কে কোন বাক্সের মগজ পেলেন এতে তেনাদের কোনো তফাৎ পড়েনা।
সন্ধ্যের অন্ধকারটা সবে ঘনিয়ে আসছে। আলোর রেস ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তরেখা ধরে। কেরানির দল টুপটুপ করে ডুব মারছেন পুকুরের জলে, আর কাদা পাঁক মেখে বাক্সবন্দি মগজ হাতে হাসিমুখে বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছেন। পথের ধারে তাদের দেখে হাসার মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম। এদের দেখে যারা দিব্যি মুখ ফিরিয়ে নিজের নিজের কাজে মন দিচ্ছেন তারা হলেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় বাবুগন। শুধরে দেওয়া তো দূর অস্ত, কাদা পাঁক থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতেই তারা ব্যস্ত। এনারা নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলতে এতটাই পটু যে প্রবল বৃষ্টিতেও এনাদের ছাতার প্রয়োজন হয় না, দিব্যি সুট প্যান্ট টাই এঁটে বৃষ্টির ধাঁরা থেকে গা বাঁচিয়ে এঁরা অফিস থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে অফিস ছুটে বেড়ান। চোখের ওপর ঠুলি আর গায়ে সুগন্ধি আতরে এদের চেনা যায়। খাওয়ার টেবিলে, চায়ের আড্ডায়, তাসের আসরে এরা পৃথিবী উল্টেপাল্টে ফেলেন গলার জোরে। তারপর বাড়ি ফিরে এসে সেই কথাগুলি নস্যির কৌটায় ভরে নাকে দিয়ে ঘুম লাগান। হাঁচির সাথে সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় সমস্ত যুগান্তকারী বক্তব্যের বাস্তবতা।
অগত্যা দুই শ্রেণির মানুষ দুটি সমান্তরাল সরলরেখা বরাবর হেঁটে চলেছেন। সূর্যের আলো, রাতের জ্যোৎস্না, মেঘ বৃষ্টি, আলো বাতাস, সবই এদের কাছে সমানভাবে পৌছলেও, ব্যাবহারগত ভাবে সব আলাদা আলাদা। এঁরা একে ওপরকে লম্বদূরত্বে দেখেন, ভুরু কোঁচকান, মুচকি হাসেন আর নিজের নিজের পথে দিব্যি হাঁটা লাগান লম্বদূরত্ব বজায় রেখে। যতক্ষণ না সামনাসামনি হচ্ছে এভাবেই চলতে থাকে সব। প্রাকৃতিক শারীরিক কিম্বা মানসিক বিকৃতিজনিত কারণে যদি সামনা সামনি হয়ে যায় এই দুই শ্রেণির, সমস্যাটা সেখানেই শুরু। একবাক্স অকার্যকরী মগজ ও হুকুম মানার অদম্য ইচ্ছা আর একবাক্স নৈরাশ্যের সম্মুখসমরে জয় পরাজয় নির্বিশেষে ক্ষয় হয় সমাজ, ক্ষয় হয় এত শতাব্দী ধরে তিল তিল করে গড়ে তোলা মানব সভ্যতার।
কোন সরলরেখা ধরে হাঁটবো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই ব্যাস্ত,সবাই। কিন্তু তার আগে একবার ভেবে দেখলে ভালো হয়, সরলরেখা গুলি কি সত্যিই সরল, নাকি আমাদের সীমিত দর্শন এবং স্তিমিত মগজাস্ত্রের অত্যাল্প আস্ফালনের কারণে আমরা আমাদের চারিপাশের ক্রমচক্রায়িত গ্রন্থিবদ্ধ বাস্তব থেকে বিমুখ।

Sunday, June 19, 2016

লুকোচুরি

ক্লাসটা শেষ হোতে তখনো অনেকটা সময় বাকি। রসায়নের গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডে তখন মন ডুবিয়ে দিয়েছি। হঠাৎ গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডের তেজে মনটা গলে যেতে শুরু করলো। কিছুটা মন সালফেট হয়ে অধঃক্ষিপ্ত হোলো আর বাকিটা জলের সাথে মিশে ছুটে বেড়াতে লাগলো বিশ্ব ব্রম্মান্ডে। যাবতীয় ক্ষারকিয়, মেঘ বৃষ্টি, প্রেম ভালবাসা, মাঠ ময়দান, ধ্যান ধারনা, সবকিছুর সাথে বিক্রিয়া শুরু হোলো। জমে উঠতে লাগলো স্মৃতির ওপর স্মৃতির অধঃক্ষেপ। আর আছড়ে পড়তে লাগলো একটার পর একটা ঢেউ মনের কিনারে। ক্লাস শেষ হোলো, স্কুল ছুটি হোলো কিন্তু সালফিউরিক অ্যাসিডের প্রভাব গেল না মন থেকে। স্কুল থেকে ফিরছি। চারিদিকে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে, বৃষ্টিও পড়ছে সামান্য। কাদামাখা রাস্তা বেয়ে হেঁটে বাড়ির দিকে চলেছি। হঠাৎ আমার নাম ধরে কে যেন ডাকছে মনে হোলো। আধভেজা একটা কাগজ আমার হাতে গুঁজে দিয়ে যে মেয়েটা আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না, তাকে রোজ দেখি, কিন্তু তার এই বৃষ্টিমাখা আলোআঁধারি রূপ এর আগে দেখেছি বোলে মনে হোলো না। সে যে পথ দিয়ে ছুটে গেলো সেই পথের দিকে কতক্ষণ যে তাকিয়ে ছিলাম, কোন কোন ভাবনার জগতে যে বিচরণ কোরে বেড়িয়েছি, তার হিসাব শুধু গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডে ডুব দিলে পাওয়া যাবে। যখন বাস্তবে ফিরলাম, আমার হাতের কাগজটা আমার হাতেই ডেলা পাকিয়ে গেছে। অ্যাসিড ভেজা মনটা, সে যেন ক্ষার মিশিয়ে লবণাক্ত কোরে দিয়ে গেলো। কিজানি আজ হয়তো অন্যদিনের মতই মেয়েটি তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মাতবে, কিম্বা হয়তো আমার মতই ভাবনার জগতে বিচরণ করবে, যদি আরেকবার দেখা হয়ে যায় ভাবনার জগতে সেই আশায়। বাড়ি ফিরেছি বেশ খানিকক্ষণ হোলো। বৃষ্টি ভেজা জামাকাপড়, কাদামাখা জুতো এখনো আমায় জড়িয়ে। সেই মুহূর্তের সবকিছুই আঁকড়ে ধরে রাখতে ইচ্ছে করছে। বেশ কয়েকবার মায়ের বকুনি খেয়েছি ইতিমধ্যে। সামনের টেবিলে মুড়ির বাটিটা যেই-কে-সেই। আমি যেন মুড়ির বাটিতে ঢুকে পড়েছি। একেকটা মুড়ির আড়ালে আড়ালে লুকোচুরি খেলছি আর অপেক্ষা কোরে আছি, কেও পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরবে আর বলবে, ধাপ্পা। মায়ের তীব্র বকুনির জেরে, ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে আলমারি থেকে শুকনো গরম জামাকাপড় বের করতে আলমারি খুলে জামাটা যেই বের করতে যাবো, অমনি কে যেন জামাকাপড়ের আড়ালে টুকি বোলে ডেকে উঠলো। মনকে আর আটকে রাখা গেল না। এবার ডুব দিলাম রঙ বেরঙ্গের জামাকাপড়ের সমুদ্রে। যে জামাকাপড় গুলো রোজ ঘামে বৃষ্টিতে ভিজে ছুঁড়ে ফেলি, ফুটবলের মাঠে কাদায় গড়াগড়ি খাই, আজ যেন হঠাৎ সেই জামাকাপড় গুলো খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। আলতো হাতে একটার পর একটা জামা সরিয়ে সরিয়ে দেখতে লাগলাম আর খুঁজতে লাগলাম তাকে। বইখাতা খুলে বসেছি। হঠাৎ বই থেকে সব যেন ডানা মেলে বেরিয়ে পড়তে লাগলো। জ্যামিতির আকার, ক্যালকুলাসের হিজিবিজি, সুদাসলের টাকা পয়সা, ঐকিক নিয়মের দেওয়াল রাস্তা মাঠ শ্রমিক সব যেন ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো সমাকলন এর দাঁড়ি আমার মাথায় গাঁট্টা মেরে যাচ্ছে তো কখনো ঐকিক নিয়মের শ্রমিক আমার চুল টেনে বর্গমূলের নিচে লুকিয়ে পড়ছে। সারাটা সন্ধ্যে, সারাটা রাত, এভাবেই লুকোচুরি খেলে গেলাম কতরকম ভাবে। লুকোচুরি খেলতে খেলতে কখন যে ঘুমের দেশে ঢলে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। পরের দিন সকালে ওঠা থেকে ভুলেই গেছিলাম আগের দিনের কথা। দিব্যি রোজের মতন স্নান খাওয়া পড়া, স্কুলের শুকনো জামাকাপড়, জুতো মোজা, মায়ের হাতের গরম ভাত, সব কিছুই ছিল সাধারণ। বাড়ি থেকে বেরোতে যাবো, হঠাৎ একটা ফোন। ফোনের ওদিকে বিল্টুদা, আমাদের স্কুলের সিনিয়র। :- কাল আমি স্কুলে যাইনি। বোনের হাতে রসায়ন এর স্যারের নাম্বার টা পাঠিয়েছিলাম। স্যার বোল্লেন তুই নাকি ফোন করিসনি। :- দাদা কাগজটা বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, তুমি আমাকে নাম্বার টা বোলে দাও আমি লিখে নি।
সালফিউরিক অ্যাসিডের ছোঁওয়া যে কতটা বিপজ্জনক তা টের পেলাম ঠিকই, তবুও অধঃক্ষিপ্ত স্মৃতিগুলো আজও তরতাজা। তাই সালফিউরিক অ্যাসিড আজও আমার প্রিয়, আজও আমার প্রিয় শব্দ টুকি, আর আজও আমার প্রিয় খেলা লুকোচুরি।

Thursday, June 16, 2016

সঙ্গোপনে

জীবন একটা রঙ্গশালা, ভাঙা গড়ার যাত্রাপালা, প্রেম বিরহ দহনজ্বালা, মুখোস ঢাকা সব।
লোকের মাঝেও হারিয়ে যাওয়া, চোখটি খুলেও হোঁচট খাওয়া, মেকি সকল চাওয়া পাওয়া, ধুসর অবয়ব।
ব্যবহারিক দ্রব্য সকল, ভাব অভিমান সবই নকল, মনমধ্যে কেবল ধকল, অনাবিল তাণ্ডব।
টুকরো কিছু আঁকড়ে ধরে, সবাই আছে বেঁচে মোরে, যে যার নিজের মতন কোরে, সাজায় মোচ্ছোব, সঙ্গোপনে।

Tuesday, June 14, 2016

কর্তৃপক্ষ

ক্যাটাপুল্টে টান ধরেছে, ধকল নিতে রাজি, রুক্ষ ডাঙায় লক্ষ্যভেদী বিফল বোমাবাজি। কালো হয়েছে হেঁসেল-হাঁড়ি অভিজ্ঞতার দামে, আজও আকাশ কালো হোলে প্রবল বৃষ্টি নামে।
উড়ছে ধুলো, তাকলা মাকান, শ্বাসকষ্ট ভারি, ধমনি বেয়ে ছুটছে পারা, তীব্র, স্বেচ্ছাচারী। আগল টানা চোখের কোণে জমতে থাকে ঘাম, ক্ষমতাধারী কর্তৃপক্ষ তোমাকে সেলাম।