রামবাবু সবে তার গ্লাভস খুলে হাত টা ধুয়ে টেবিলের দিকে পা বাড়িয়েছেন, হঠাৎ
দরজায় একটা টোকা। 'কাম ইন' বলে চেয়ারটা টেনে বসতে বসতেই এক ছিমছিমে
চেহারার সুসজ্জিত জামাকাপড় পরিহিত ছেলে দরজা আলতো করে খুলে মুখ বাড়িয়ে
বোল্লো, 'স্যার আরো একজন এসেছে, কি করি!' ছেলেটা রামবাবুর কম্পাউন্ডার,
বিভু। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক মুহুর্তে নিজের ডান হাতটা দিয়ে মুখের ঘাম
মুছে রামবাবু বললেন, 'ভেতরে নিয়ে এসো'।
সময়টা প্রায় মধ্য রাত্রি,
বেশ কয়েকবার নিজের টিফিন বাক্স টা খুলে রাতের খাবারটা খেয়ে নেওয়ার চেষ্টা
করেও বিফল হয়েছেন রামবাবু। বাইরের অবস্থাটা এখন খুবই শান্ত, তবে মাঝে
মধ্যেই অস্থির করা শব্দ কানে আসছে।
এরপর দরজা দিয়ে যে চেহারাটা
ভেতরে ঢুকে এলো, তার অগোছালো চুল, লাল কালো জমাট বাঁধা রক্তের ছোপে ভরা
মুখের সাথে মানানসই কালি পড়া সন্ত্রস্ত চোখে চোখ রেখে রামবাবু বললেন, 'বলুন
কি সাহায্য করতে পারি'! কাতর গলায় কম্পমান ঠোঁটের অবাধ্যতা সামলে সে উত্তর
দিল, 'স্যার, আমার ডান উরুতে একটা গুলি লেগেছে, প্রচন্ড ব্যাথায়
কাতরাচ্ছি, যদি একটু দেখে ওষুধ দিয়ে দ্যান।' চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে, দু পা
হেঁটে তার দিকে এগিয়ে এসে তার উরুতে চোখ বুলিয়ে স্থির গলায় রামবাবু বললেন,
'গুলি লেগেছে শুধু নয় বিঁধে আছে। সামনের বেড টায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়'।
ভদ্রলোকের হাঁটা আগে চোখে পড়েনি, এবার বেড অব্ধি যেতে তার কষ্টটা চোখে
পড়লো। পা টিপে টিপে, ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপে সে এগোচ্ছে আর প্রত্যেক
পদক্ষেপের সাথে ব্যাথায় বিকৃত হয়ে যাচ্ছে তার মুখ। হাতে গ্লাভস পরে শুরু
হোলো তার অস্ত্রোপচার।
লোকাল এনেস্থিসিয়ার ইঞ্জেকশনটা দিতে দিতে রামবাবু তাকে প্রশ্ন করলেন,
- 'কিভাবে হোলো এটা'?
- 'স্যার আর বলবেন না, গ্রামের প্রান্তে আমার মুদিখানার দোকান। হঠাৎ দেখি
পাশের গ্রামের মুসলমানরা আমাদের দোকানগুলোতে আগুন লাগাচ্ছে। সেই দেখে আমরা
সবাই যা হাতের কাছে পাই, লোহা লক্কড়, সাবল গাইঁতি, নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু
ওরা অনেকে ছিলো। বেস কয়েক লাঠির ঘা, জ্বলন্ত আগুন ঠেলে কোনো মতে পালিয়ে
বেঁচেছি। এই গন্ডগোলের মধ্যে কেউ পিস্তল ও চালিয়েছে। তারই একটা এসে লেগেছে
আমার উরুতে, প্রাণে বেঁচে গেছি, এই রক্ষে।'
ইতিমধ্যে অস্ত্রোপচার এর বাক্স খুলে, যন্ত্রপাতি গুলো কে স্টেরিলাইজ করতে করতে প্রশ্ন করলেন রামবাবু,
- ' কিন্তু হঠাৎ আগুন লাগালো কেন?
- 'স্যার ওরা এরকমই। আমাদের গ্রাম থেকে জল নিয়ে যায়। ওদের ছোওয়ায় আমাদের
জাত যাবে না, তাই আমরা ওদের জল নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। তবুও শোনে না। তাই
কেও এদিকে জল নিতে এলে পাথর মেরে তাড়িয়ে দি। আজ সকালে একটা বাচ্চা স্কুল
যাওয়ার পথে আমাদের গ্রামের কলে জল খেতে এলে আমরা তাকে ভালো ভাবেই বলি জল না
খেতে, তাতে তার সাথে থাকা এক বয়স্ক ভদ্রলোকের গায়ে লাগে। সে গালিগালাজ
জুড়ে দেয়। তাতে লোকজন তাদের ওপোর চড়াও হয়, লাঠিশোটা নিয়ে। লোকটা পালিয়ে যায়
কিন্তু বাচ্চাটা পালাতে পারেনি। ঘন্টা কয়েক পরে তার লাশ নিতে এসে তলোয়ার
ভোজালি চালিয়ে জখম করে দিয়ে গেছে আমাদের বেস কিছু লোকজনকে। সেই থেকেই মার
দাঙ্গা চলছে। বউ বলেছিল আজ দোকানে না যেতে, পাত্তা দিইনি, এখন হাড়ে হাড়ে
টের পাচ্ছি',
বলেই একটা তীব্র গোঙানি। রামবাবু রক্ত মাখা চিমটে আর
ছুরিটা পাশে রেখে, 'গুলিটা বের করে দিয়েছি, হাত টা ধুয়ে এসে ওষুধটা লাগিয়ে
ব্যান্ডেজটা করে দিচ্ছি' বলে আবার গ্লাভস টা খুলে হাতটা ধুতে লাগলেন।
হঠাৎ বাইরে আবার সেই চিল চিৎকার শোনা যেতে লাগলো। তবে এবার সেটা মুহুর্তে
থামলো না। চিৎকারের শব্দ আরো প্রকট হতে লাগলো। দড়াম করে দরজা খুলে ঢুকে
পড়লো বিভু। রামবাবু কিছু বুঝে ওঠার আগেই গলগল করে বইতে থাকা রক্তে ভেসে
গেলো মেঝেটা। ডান হাতটাকে বাম হাত দিয়ে জোরে চেপে বিভু বললো, 'স্যার
তাড়াতাড়ি পেছনের দরজা দিয়ে পালান, ওরা ঢুকে পড়লো বোলে।' তার কথা শেষ হতে না
হতেই দরজা প্রায় ভেঙেই একদল ছেলে ঢুকে পড়লো। সবার হাতে লাঠি, তরোয়াল।
ঢুকেই প্রায় থ মেরে গিয়ে একজন রামবাবু কে দেখে বলে উঠলো, 'রহমত আলি খাঁ
সাব, আপনি! আপনি এ গাঁয়ে কি করছেন। এই শুয়োরের বাচ্চাদের চিকিৎসা করছেন। এর
খেসারত কিন্তু আপনাকে দিতে হবে'। রামবাবু বিভুর দিকে এগিয়ে গিয়ে, তার বাম
হাতটা সরিয়ে ডান হাতটা দেখতে দেখতে বোল্লেন, 'তা তোমরা কি চাও, এভাবে
সবাইকে মেরে ফেলবে!' আরো একটু মৃদু গলায় বিভুর চোখে চোখ রেখে, 'ছুঁয়ে
বেরিয়ে গেছে। ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে', বলেই ছেলেগুলোর দিকে মুখ
ফিরিয়ে বললেন,
-'কি হোলো, উত্তর দাও'।
-'কিন্তু খাঁ সাব আপনি থাকতে, আপনাকে আব্বু আম্মি খুব শ্রদ্ধা করেন। আপনি যদি আমাদের পথটা ছেড়ে দেন।'
-'আর যদি না ছাড়ি'!
-'তাহলে আমরা ভুলে যাবো আপনি কে'।
ঠোঁটের কোণে একটা আলতো হাসি টেনে এনে বলতে শুরু করলেন রামবাবু ওরফে রহমত আলি।
-'তখন সত্তরের দশক, গাঁয়ে মহামারি, প্রায় সব ঘরেই কেউ না কেউ আক্রান্ত।
তখন হিন্দু মুসলমানদের আলাদা আলাদা গ্রাম ছিলো না। আমি সবে গাঁয়ে এসেছি।
নতুন ডাক্তার। সেভাবে কেউ চেনেনা আমাকে। গাঁয়ের ঘরে ঘরে গিয়ে চিকিৎসা করে
বাঁচিয়ে তুলেছি তোদের বাপজানেদের, হিন্দু মুসলমান বিচার না করেই। আমাকেও
কেউ আমার জাত জিজ্ঞেস করেনি। তারপর হিন্দু মুসলমান ভাগাভাগি হোলো, তাই
রামবাবু হয়ে এই গ্রামে আসতে হয় চিকিৎসা করতে। আমার কাজ প্রাণ দেওয়া, তাতে
নিজের প্রাণ গেলেও আপত্তি নেই। '
-'বেস তবে তাই, আপনি যখন পথ ছাড়বেন না..'
ছেলেটার কথা কেটেই রাম বাবু বললেন,
-'তুই নিসার আলির ছেলে, দিলওয়ার না। তোর মা তখন পোয়াতি, যক্ষায় ধরেছে
তাকে। নিসু আমাকে বলেছিল, বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারুন না পারুন, বৌটাকে
বাঁচান। ওর কাঁধ চাপড়ে বলেছিলাম, মেয়ে হলে নাম দিলরুবা রেখো আর ছেলে হলে
দিলওয়ার।'