মৃত্যু ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। বেশ কয়েক জায়গায় পড়েছি, অন্ধকারের যেমন অস্তিত্ব নেই, তা শুধু আলোর অভাব মাত্র, সেরকমই জীবনের অভাবই হোলো নাকি মৃত্যু। এ বিষয়ে আমি সহমত কি না, সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে এটা বোলে রাখি, মৃত্যুকে আমি ভয় পাই না, ভয় পাই জীবনকে। আর তাই মৃত্যুর প্রতি আমার বিনম্র স্রদ্ধা।
আমি, আমরা, রোজ মৃত্যু দেখি। কারুর বুক ভরা আশার তো কারুর অদম্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার । আর তার সাথে মিশে থাকা আরো জনা কয়েক মানুষের দুচোখ ভরা স্বপ্নের সলীলসমাধি আমাদের খুব চেনা। সমাজের হাড়হিম করা অবয়বের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকা সামাজিকতাও মরছে রোজ, রাস্তায় বাজারে গলির মোড়ে চোখ রাখলেই দেখতে পাই শ্মশান যাত্রীর ঢল। আমি একা নই, আমরা সবাই রোজ নিয়ম করে দেখি। নিয়ম করে মানবিকতার ক্রমমৃত্যুতে আমরাও অংশীদার। কিন্তু এসব মৃত্যুও আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। আমরা এতে ভয় পাই না, ভয় পাওয়ার কিছু আছে বোলেও মনে করি না। আসলে মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় না। মানুষ ভয় পায় অভ্যাসের মৃত্যুকে।
মৃত্যু, একটা মানুষের, একটা জীবনের, একটা সম্পর্কের। আর তার সাথে তার জীবনযাপনের। তার আচার ব্যাবহার, তার দৈনন্দিন চালচলনের সাথে মিশে থাকা আমাদের অভ্যাসের। মানুষ এমন একটি প্রাণী যা পরিবর্তন দেখে আনন্দ পায় কিন্তু নিজেকে, নিজের পারিপার্শ্বিককে পালটে ফেলতে গেলে পিছিয়ে আসে। এককথায় মানুষ অভ্যাসের দাস। ছোটবেলা থেকেই আমাদের অভ্যাস বশবর্তী হতে শেখানো হয়। সকাল-বিকেল নিয়ম করে পড়তে বসা থেকে শুরু করে সকাল-দুপুর-রাতে খাওয়ার অভ্যাস, সকালে রাতে নিয়ম করে দাঁত মাজা সবই আমাদের রক্তে মিশে গেছে। এইসব নিয়মানুবর্তিতা আমাদের নিয়মানুগ হতে শেখায় ঠিকই কিন্তু তার সাথে নিয়ম পালটে ফেলার প্রয়োজনবোধটাও আসতে আসতে ক্ষয় হতে থাকে। তবুও যেদিন নিয়মের বাইরে পরিবারের সাথে রাতের খাবারটা রেস্তোরাঁয় হয় কিম্বা সন্ধ্যের পড়াটা ব্যাতি রেখেই যখন মেলা ঘুরে আসা হয় বন্ধুদের সাথে, আনন্দটা কয়েকগুণ বেশি হয়, মন আনন্দে ভরে ওঠে। আয়ত্তে আনা নিয়মানুবর্তিতা কখনই মানুষের আদিম উশৃঙ্খল প্রবৃত্তিকে ছাপিয়ে যেতে পারে না, সুপ্ত থাকে মাত্র। প্রয়োজনে এই আদিম প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলতে না পারলে মানব আর যন্ত্রমানব এর কোন পার্থক্য থাকে না।
আর সেখানেই আমার ভয়। মৃত্যুকে নয়, জীবনকে। এই জীবনকে যেখানে মানুষ অভ্যাসের দাস, যেখানে মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসে মানবিকতার, সামাজিকতার মৃত্যু মিলেমিশে একাকার। আমার ভয়, মানুষকে নয়, মানুষের যন্ত্র মানবিকতার প্রতি অভিসারকে। তাই যখনই কারুর মৃত্যুতে দুচোখ ভাসাবেন, একবার ভেবে দেখবেন, আমাদের অভ্যাসগত মৃত্যুও কিন্তু অনেকের অভ্যাস বহির্ভূত মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে থাকা অশ্রুর জন্য দায়ী।