Tuesday, October 25, 2011

জীবনের শেষ রাতে


সেদিন এর ঘটনা টা বড়ই ঝাপসা এখন , শুধু মনে পড়ে - একটা শীতের বিকেলের  মলিন রোদ্দুর , একটা অর্ধ হরিত বৃক্ষের ওপর বসে থাকা চড়ুই গুলির কিচির মিচির। আকাশটায় তখনও আন্ধার নেমে আসেনি, পশ্চিম কোণে তখনও কিছু পেঁজা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।  আমি বারান্দায় বসে ক্লান্ত রাস্তার দিকে অধীর দৃষ্টে তাকিয়ে আছি , দেখছি - গ্রামের কৃষক রা তাদের বাসার দিকে ফিরছে। তাদের চেহারায় দিনভরের ক্লান্তির ছাপটা ক্লান্ত রাস্তার সাথে বেশ মানিয়ে যাচ্ছে , যেন একজন চিত্রকর তার জীবনের ফ্যাকাশে কানভাসে  মলিন ইতিহাসের তুলি বুলিয়েছেন ।  
দিনটা আমার খুব একটা ভালো যায়নি, সকাল থেকে একটার পর একটা দুঃসংবাদ শুনেই চলেছি
........ আমাদের পাশের বাড়ির নেত্রাদির বিয়েটা বোধ হয় আবার ভেঙ্গে যাবে। তাদের পরিবার এর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, তিন তিন টে মেয়ে। বড় দুজনের বিয়ে দিতে গিয়ে পলাশ কাকু, নেত্রা দির বাবা, তাদের পরিবার টাকে প্রায় পথে বসিয়েছেন। এই অবস্থায় বিয়ে টা ভেঙ্গে যাওয়া, পরিবার টার ওপর যে কি প্রভাব ফেলবে তা শুধু ভবিষ্যত-ই বলতে পারে !
.... চঞ্চল দার বাবার অসুখ টাও  নাকি আরো বেড়েছে, অথচ তাদের সাংসারিক গোলযোগের মাত্রা যে কমবার নাম নেয় না, ভেবেই পাই না তাদের পরিবার এর নিয়তি তে কি লেখা আছে !
..... আমাদের গ্রামের সীমান্তে থাকেন হাঁসু কাকা, তার কি যেন একটা বিষম ব্যাধি ! তাই গ্রামের মধ্যে তার ঢোকা বারন। আজ শুনলাম তিনি নাকি জল নিতে গ্রাম-এ এসেছিলেন। গ্রামবাসীরা তাকে পাথর মেরে মেরে গ্রামের বাইরে বার করে দিয়ে আসে। কে  জানে তার অবস্থা এখন কেমন ! নাহ  আর ভালো লাগে না ......
          তাও যেন কোন এক আশায় বসে আছি, দিনের শেষ টা ভালই হবে ! কেন জানি না , কিন্তু একটা অদ্ভুত বিশ্বাস কাজ করছে ... এত দরদে যারা কাহিল তাদের দুঃখকেও ছাপিয়ে যাবে এমন কোনো একটা সুসংবাদ পেতে চলেছে আজকের রাত্রি  ...


হঠাত যেন একটা আওয়াজ কানে এলো - " রাজু , চল রে খেলতে যাব "।   কিছুটা বিস্মিত-ই হয়েছিলাম  বটে! কি যেন ভাবতে ভাবতে ভুলেই গেছি আজ-ই আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে।   আমি থাকি হোস্টেল -এ।   আমাদের বাড়ির অবস্থা গ্রামের অন্যদের তুলনায় সচ্ছল, তাই আমাকে বোর্ডিং এ দেওয়া হয়েছে।  হোস্টেল এ থাকার সময় যেমন মা বাবার অভাব টা প্রচন্ড বোধ করি ঠিক তেমনি আমার গ্রামের বন্ধুদের-ও।  তাই  হোস্টেল থেকে আসার সময় বন্ধুদের বলে এসেছি আজ জমিয়ে খেলা হবে।  এর-ই মধ্যে প্রদীপ আমার পাসে এসে দাড়িয়েছে।  ঘাড় ঘোরাতেই নজরে পড়ে তার সেই চিরপরিচিত সুদীর্ঘ অবয়ব টি -  একটি আধময়লা বেগুনি রঙের জামায় ঢাকা, জামার বোতাম বেশির ভাগ-ই নেই, নিচের প্রান্ত টায় একটা সেফটি পিন লাগানো যাতে সেটি খুলে না যায়!  তার তেলচিট চুল থেকে বেরিয়ে আসছে একটা পঁচা তেলের গন্ধ , যা আমার ঘরটাকে ভরিয়ে দিয়েছে।  আমি তার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাঁসি দিয়ে ছুট্টে চলে গেলাম ভেতর ঘরে।  জানি না কেন, কিন্তু হোস্টেল-এ থাকার সময় আমি যে জামাগুলি পরি সেগুলো আমি এখানে এসে পরতে পারি না।  আমি-ও খুঁজে  বেড়ায় ওই  প্রদীপ দের মতই ছেড়া তেলচিটে জামা।  যথা সাধ্য চেষ্টা করে একটা ময়লা জামা খুঁজে পরলাম , আর তারপর প্রদীপ এর সাথে বেরিয়ে পড়লাম খেলতে।  ও বলতে ভুলে গেছি , এই প্রদীপ হলো , তোমাদের যে নেত্রা দির কথা বলেছি তার ছোট ভাই , পড়ে আমার-ই ক্লাস এ , ক্লাস সেভেন।   অনেক দিন পর সেই গ্রামের রাস্তায় বেরোলাম - ছোট ছোট পাথর কুচি তে ঢাকা প্রায় সাদা রাস্তা , খালি পায়ে হাঁটলে আমার পা-এ জ্বালা ধরে যায়।  অথচ এই রাস্তায় আমার সব গ্রামের  বন্ধুরা দিব্বি খালি পায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।   রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম কয়েকমাস আগে যাদের সাথে আমি খেলেছি সেই দাদা রা হঠাত-ই যেন আমার থেকে অনেক টা বড় হয়ে গেছে।  তাদের কাছে গিয়ে কথা বলতে আমার কেমন বেশ একটু লজ্জা-ই করছিল ! বলাই বাহুল্য প্রদীপ কিন্তু আমার মতই আছে , বরং আমি-ই ওর থেকে একটু বেশি লম্বা !  তাই যথা সম্ভব ওই দাদাদের এড়িয়ে প্রদীপ এর হাতটা ধরে এগিয়ে চললাম মাঠের দিকে।  যাওয়ার পথেই দেখা হয়ে গেল অনেক পরিচিতদের সাথে, কেও আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসল, কেও আবার মাথায় হাথ বুলিয়ে দিল।  আমি অবশ্য বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতির।  তাই কোন মতে সব্বাই কে একটা মুচকি হাঁসি দিয়েই সটান দৌড়।  শেষে পৌছে গেলাম আমাদের খেলার মাঠে।   সুমন দের খামার বাড়ি।  একদিকে তাদের খড়ের চাল দেওয়া কুঁড়ে ঘর এর পেছনের দিকের মাটির দেয়াল, যাতে পাথরে দাগ কেটে হবে আমাদের উইকেট। তার উল্টোদিকে কিছুটা এগোলেই খামার বাড়ির শেষ, সেখান থেকে শুরু আমাদের গ্রামের পুকুর পাড়।  একটা দিকে সুমন দের বাড়ির দেয়াল ধরে কিছুটা বাম দিকে এগোলেই একটা প্রকান্ড তেঁতুল গাছ , তার-ই নিচে আমাদের প্যাভিলিয়ন।   অন্য দিকটা ফাঁকা , কিছু টা দূর থেকেই শুরু হচ্ছে ধানক্ষেত।  সুমন হলো চঞ্চল দার ভাইপো, তার দাদুর শরীর টা খারাপ থাকার জন্য সে বেশিরভাগ দিনই খেলতে আসে না, তবে আমি আজ এসেছি বলে সে এসেছে খেলতে।   আমাদের বোর্ডিং এ আমি খেলতে এলাম কি না এলাম কেও পাত্তাই দেয় না, কিন্তু আমার গ্রামের বন্ধুরা তাদের সব কাজ ছেড়ে ছুট্টে এসেছে আমার সাথে খেলার জন্য, ভেবে মনটা আনন্দে ভরে যায় , কখনো ভাবি - 'আর বোর্ডিং এ ফিরে যাব না' ! খেলার শেষে হঠাতই মনে পড়ে গেল  প্রদীপ এর দিদির বিয়ে টা তো ভেঙ্গে গেছে , একবার জিগ্গেস করে দেখলে হয় না ব্যাপার টা কি।  এখন ওদের অবস্থা টাই বা কেমন ! রাস্তায় হাটতে হাটতে হঠাতই সাহস করে  জিগ্গেস করে বসলাম প্রদীপ কে ওর দিদির বিয়ের ব্যাপারটা, আর তার পর যেটা হলো তার জন্য আমি আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না।  রাস্তার থেকে একটা আদলা ইট তুলে মারলো আমার মাথায়।  সঙ্গে সঙ্গে কপালের ডানপাশে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম , মাথা টা কেমন ঘুরতে লাগলো , আর আমি লুটিয়ে  পড়লাম রাস্তার ওপর I আমার চোখ দুটো আমি সজোরে চেপে বন্ধ করে রেখেছি , বুঝতে পারছি আমার ডান চোখটার ওপর দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরছে।  বাঁ চোখটা সামান্য খুলে দেখার চেষ্টা করলাম , একটা আবছা চলচ্ছবির মত দেখলাম প্রদীপ ছুটতে ছুটতে আমার থেকে দুরে আরো দুরে চলে যাচ্ছে।   তারপর চোখটা কখন যে বন্ধ হয়ে গেছে তা আর টের পায়নি।  চোখ যখন খুললাম তখন আমি আমার বিছানায় শুয়ে আছি, মাথায় একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা।   মা আমার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বোলাচ্ছে।  মাথার চিনচিনে ব্যথা টা এখন টনটনে ব্যথার রূপ নিয়েছে।  হঠাত একটা পরিচিত গলার শব্দে চোখ ফেরাতেই  নজরে পড়ল আমার খাটের ঠিক পাসে একটা চেয়ার-এ বসে আছেন  শ্যামল কাকুর স্ত্রী।  আমাকে চোখ খুলতে দেখে তিনি বলে উঠলেন " ওই  যে  ছেলেটার জ্ঞান ফিরেছে , আহারে বেচারাকে কি ভাবে মেরেছে দেখো , যদি ওর কাকু ওখানে না থাকত তাহলে কি যে  হোত ছেলেটার " ।  ওনার কথা শুনে বুঝলাম যে শ্যামল কাকুই আমাকে ওই অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ঘরে নিয়ে এসেছেন।  আমার ঘুমের ঘোর টা বোধ হয় এখনো কাটেনি, সব কিছুই প্রায় আবছা দেখছি।


রাত যত বেড়েছে ব্যাথাটাও ততটাই। আর তার সাথে টের পেয়েছি মাথার সাথে বুকটাও কেমন যেন ধড়ফড় করছে। গ্রামের জীবনযাত্রাটা ওই খোলা মাঠ, গাছপালা, পাথর মোড়া রাস্তা, ধানক্ষেতের চেয়েও অনেক বেশী কিছু। এখানে এখনো বিদ্যুৎ এসে পৌঁছায়নি। শহুরে মানুষদের জীবনের একাকিত্বের ভালো এবং মন্দ দুটোদিক পরিষ্কার হয় একবার গ্রামে এসে এদের জীবনযাত্রা দেখলে। প্রদীপের এই ব্যবহারটা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো তাই মাকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, "মা প্রদীপটা ওরকম কেন করলো"। শুনে যা বুঝলাম, নেত্রাদির বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর জমি জায়গা বেচে প্রদীপরা প্রায় সর্বশান্ত হয়েছে। বাড়িতে তাদের ঝামেলা লেগেই থাকে। এসবের বেশ খারাপ প্রভাব পড়েছে প্রদীপের ওপর। সবাই বলে প্রদীপের মাথাটা নাকি খারাপ হয়েছে। অনেকেই নাকি ওকে দেখে দূর থেকে আধলা ইঁট পাথর ও ছোঁড়ে। নেত্রাদির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করাটা আমার বোধহয় ঠিক হয়নি। এই প্রদীপ আর সেই বছরখানেক আগের প্রদীপ নেই। শহরে এরকম হলে এতক্ষণে পুলিশ অবধি গড়াতো ঘটনাটা। কিন্তু গ্রামের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। যে প্রদীপকে ছোট্ট থেকে দেখে আসছি, যার সাথে কত আম চুরি, তাস খেলা থেকে শুরু করে দোকান বাজার হাটের হাজারো স্মৃতি জড়িয়ে ,তার ব্যাপারে ভেবে আমার মাথার ব্যাথা উপেক্ষা করেই চোখ দুটো ভিজে এলো। 


রাত তখন কটা হবে ঠিক খেয়াল নেই।  গ্রামের দিকে ঝুপ করে সন্ধ্যে নামে, আর রাতের গভীরতাটাও শহুরে রাতের চেয়ে যেন কয়েকগুন বেশি। চারিদিক প্রায় নিঃস্তব্ধ, বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথার টনটনে ব্যাথায় ঘুমটা আমার বারবার ভেঙে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার নাকে ভেসে উঠলো আবার  সেই পচা তেলের গন্ধটা। বেশ অন্ধকার চারিদিকে, পাশে লণ্ঠন একটা আছে বটে, তবে তার আলোয় শুধু লণ্ঠনের উপস্থিতিটুকুই দেখা যায় মাত্র।
                                                              .................ক্রমশ..................

No comments:

Post a Comment