বড্ড অস্বস্তিকর লাগছে, কিছুতেই ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছি না। জট পাকানো চিন্তাভাবনায় জর্জরিত হয়েই ছুটছি স্টেশনের দিকে। হাতে আমার কালো ব্যাগ, গায়ে ছাপোষা কালো কোট, সাদা জামা, কালো প্যান্ট। টাই টা ঢিলে হয়ে ঝুলছে গলায়। স্টেশনের দরজা দিয়ে ঢুকছি, হঠাৎ একটা ধপাস করে শব্দ। একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে মনে হোলো শুধুই আমি যেন শব্দটা শুনলাম, বাকি কারু কোনো হেলদোল নেই। মাথা না ঘামিয়ে হুড়মুড়িয়ে এক নাম্বার প্লাটফর্মের দিকে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ এক ভদ্রলোক, আমাকে এমন ধাক্কা মেরে ডানপাশের সিঁড়ির দিকে ছুটলো, আমার ডান পায়ের জুতোর ফিতে টা খুলে গেলো। ফিতে টা লাগিয়ে সবে এগোতে শুরু করেছি, হঠাৎ মনে হোলো, লোকটা ঠিক যেন আমার মত দেখতে ছিল। গায়ে সাদা জামা, কালো প্যান্ট, অবশ্য কোট-টাই নেই। ফিরে তাকালাম সিঁড়ির দিকে। লোকটা ততক্ষণে সিঁড়ির অর্ধেকটা উঠে গেছে। ঠিক আমারই মত একটা কালো ব্যাগও তার হাতে। সেটা খুলে কি যেন হাতড়াচ্ছে সিঁড়ির মাঝপথে দাঁড়িয়ে।
কানে এলো গাড়ির অ্যানাউন্সমেন্ট, 'কৃপয়া ধ্যান দে, কলকত্তা সে হোকর বর্ধমান কো জানে ওয়ালি সাওয়ারি গাড়ি তিন নম্বর প্লাটফর্ম পর আ রহি হেয়'। তিন নাম্বার, সে তো ওভারব্রীজ ক্রস করে যেতে হবে! অনেকটা পথ রোদ গরমে এসেছি, তাই একটু চোখে মুখে জল দেওয়ার জন্য ওয়েটিংরুমের বাথরুমে ঢুকলাম। ট্যাপটা খুলতেই তীব্র বেগে জলের ধারায় আমার চোখ মুখ কোট সব ভিজে গেলো। তাড়াহুড়োর মধ্যে একটু বিরক্ত হয়েই টাই আর কোটটা খুলে ব্যাগে ভরে নিলাম। তারপর হাত মুখ টা ভালো করে ধুয়ে, পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখটা মুছছি, ওমনি, ট্রেন ঢোকার শব্দ কানে আসতেই, ছুট লাগালাম। ওয়েটিং রুম থেকে বেরোতেই কানে এলো একটা ডাক, 'এই যে, কি করছেন'। শব্দটা ওভারব্রিজ থেকে আসছে মনে হোলো তাই ওপরের দিকে চোখ তুলতেই চোখে পড়লো, এক ভদ্রলোক নীল রঙের একটা গেঞ্জি পরে ওভারব্রীজের রেলিং এর ওপর দাঁড়িয়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, রেলিং থেকে শূন্যে ভেসে পড়লো তার দেহ। তিন নম্বর প্লাটফর্মে ঢুকতে থাকা ট্রেনের মাথার ওপর আছড়ে পড়লো, আর জোরে একটা শব্দ, 'ধপাস',।
কি, কেন এসব প্রশ্নের কৌতুহল টা সামলে ট্রেন ধরার জন্য ছুট লাগালাম। স্টেশনের গেটের মুখে প্রায় একজন ভদ্রলোককে ধাক্কা দিয়ে ডানপাশের ওভারব্রিজের সিঁড়ির দিকে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ, মূহুর্তের মধ্যে মাথায় খেলে গেলো ওভারব্রীজের রেলিঙে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মুখটা, ঠিক যেন আমি। আর গায়ের গেঞ্জি টা, ওটা তো আমারই, এখনো ব্যাগেই আছে। একবার ফিরে যাবো ভেবে নিচের দিকে ঘুরতেই দেখি যে কালো কোট পরিহিত ভদ্রলোক কে এই মাত্র ধাক্কা দিয়ে এলাম সে নিজের জুতোর ফিতে বাঁধছে। এর মধ্যে ট্রেন ছাড়ার শব্দ। হুড়মুড়িয়ে ব্যাগটা খুলে দেখলাম, ঠিক, নীল গেঞ্জি টাই তো এনেছি আজ। এখনো ব্যাগেই রয়েছে।
না ট্রেন ছাড়ছে, ছুটতে হবে। এবার ছুট্টে ওভারব্রীজের ওপরে উঠেই তাক লেগে গেলো। নীল গেঞ্জি পরে লোকটা এখনো দাঁড়িয়ে রেলিঙের ওপর। না, এখনো বাঁচানো যাবে ভেবে ছুটে লোকটার দিকে এগোতে এগোতে চিৎকার করলাম, 'এই যে, কি করছেন'। আমার চিৎকার শুনে লোকটা আমার দিকে তাকাতেই টাল সামলাতে না পেরে রেলিঙের ওপর থেকে,... ধপাস। আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি নীচে প্লাটফর্ম থেকে লোকজন আমার দিকে তাকিয়ে, কেউ কেউ আঙুলও দেখাচ্ছে আমার দিকে। এবার একটু ভয় লাগছে। লোকজন আমাকে দোষী ভাবছে না তো! ওভারব্রীজের একটা কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চট করে জামাটা বদলে নীল গেঞ্জি টা চাপিয়ে নিলাম গায়ে আর ব্যাগটা সন্তর্পণে ওই কোণ ঘেঁষেই নামিয়ে দিলাম।
হঠাৎ চোখে পড়লো, দুজন পুলিশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে আমার জিভ শুকিয়ে এসেছে। আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো, 'একজন সাদা জামা পরা লোক দাঁড়িয়ে ছিল এখানে, হাতে কালো ব্যাগ, কোন দিকে গেলো দেখেছেন কি'! আড়ষ্ট জিভ নেড়ে আমতা আমতা করে বোল্লাম, 'ওই তো তিন নম্বর প্লাটফর্ম এর দিকে যেতে দেখলাম'। আমি দেখেছি শুনে ওদের চোখ জ্বলে উঠলো, 'দেখেছেন, দেখলে চিনতে পারবেন?' এর মধ্যে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে , যা করছি যা বলছি কিছুতেই আমার আর কন্ট্রোল নেই। আর এবার বলে ফেল্লাম, 'হ্যাঁ পারবো না কেন, দিব্যি দেখলাম আমার চোখের সামনে দিয়েই তো চিৎকার করতে করতে গেলেন।' এসব শুনে আমাকেও ওরা সাথে নিল। ওভারব্রীজের মাথায় এসে আমাকে ওরা বোল্লো, 'আমরা দুজন প্লাটফর্মে যাচ্ছি, আপনি এই রেলিঙের ওপর উঠে দেখুন তো ওনাকে দেখতে পান কি না। দেখলেই আমাদের ইশারা করবেন।' আমি সাবধানে রেলিঙের ওপর উঠলাম। প্লাটফর্মে চারিদিকে চোখ ঘোরাতে লাগলাম, আমি যেন আমাকেই খুঁজছি চারিদিকে, কিন্তু কই দেখছি না তো।
আবার হঠাৎ অ্যানাউন্সমেন্ট, 'কৃপয়া ধ্যান দে, কলকত্তা সে হোকর বর্ধমান কো জানে ওয়ালি সাওয়ারি গাড়ি তিন নম্বর প্লাটফর্ম পর আ রহি হেয়'। আর এটা শুনেই মাথার মধ্যে একটার পর একটা ঘটনা লুপের মত ভেসে উঠতে লাগলো। ধাক্কা, জুতোর ফিতে খোলা, বাথরুমে জলে ভিজে কোট খুলে রাখা, রেলিঙের ওপর নীল গেঞ্জি পরা লোক, ব্যাগ খুলে হাতড়ানো সবেতেই যেন আমি। মাথায় এসব পোকামাকড়ের মত ঘিনঘিন করছে, হঠাৎ ট্রেন ঢোকার শব্দ কানে এলো। আর সাথে একটা চিৎকার, 'এই যে, কি করছেন'। ঠিক যেন আমারই গলা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সেই লোকটা, যাকে খুঁজছি এতক্ষণ তন্নতন্ন করে, সাদা জামা, হাতে কালো ব্যাগ। প্লাটফর্ম নাম্বার তিনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশদের ইশারা করতে হাত তুলতে গিয়েই বেসামাল। তারপর শূন্যে ভেসে গেলো আমার নীল গেঞ্জি পরা শরীরটা, আর চলমান ট্রেনের মাথার ওপর গিয়ে ধপাস করে পড়তেই, গা হাত পায়ে ঝাঁকুনি দিয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠলাম। হাতে এখনো ধরা সায়েন্স ফিকশনের বই, টাইম লুপ।